আজ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি অতি উল্লেখযোগ্য দিন ছিল। ১৬৩৬ সালে প্রতিষ্ঠা পাবার পর তিনশ বিরাশি বছরের ইতিহাসে মাত্র ২৯তম বার নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ পেলেন, ভদ্রলোকের নাম ল্যারি ব্যাকো। অতি বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ভদ্রলোকের- দশ বছর তিনি টাফটস ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এর আগে চব্বিশ বছর পড়িয়েছেন ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি বা এমআইটিতে।
আন্ডারগ্র্যাড করেছেন এমআইটিতে, জুরিস ডক্টরেট করেছেন হার্ভার্ড ল স্কুলে, মাস্টার্স ইন পাবলিক পলিসি করেছেন হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে এবং পাবলিক পলিসিতে পিএইচডি করেছেন হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট স্কুল অফ আর্টস এ্যান্ড সায়েন্স থেকে।
দুটো থেকে চারটা দুই ঘণ্টা অভিষেক অনুষ্ঠান, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি একটা ক্লাস থাকায় উল্লেখ্য, ক্লাস বন্ধ দেয়নাই। ক্লাস চলেছে ক্লাসের মত- এর ফাঁকে আয়োজন করেছে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষ্ঠানের। শুরুতেই ক্রিমসন রঙের স্যুট পরা ঐতিহ্যবাহী হার্ভার্ড বাদক দল এলো বাজনা বাজাতে বাজাতে। আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ( এবং আমেরিকার বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে) একটা মজার ট্র্যাডিশন আছে- এদের নিজেদের বাদক দল, প্রতীক এবং ঐতিহ্যবাহী “ফাইট সং” বা রণসঙ্গীত আছে। “টেন থাউজেন ম্যান ফ্রম হার্ভার্ড” হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে জনপ্রিয় রণসঙ্গীত- আজ থেকে একশ বছর আগে এ পুটনাম নামের ১৯১৮ ব্যাচের একজন ছাত্র এটা লিখেছিলেন। কালের অতল গহ্বরে জনাব পুটনাম হারিয়ে গিয়েছেন- কিন্তু এই গানের কথায় এবং সুরে বেঁচে আছেন তিনি।
এই গানটার লিরিকসে একটা মজার বিষয় আছে- এর দ্বিতীয় অংশ ইংরেজিতে- “টেন থাউজেন্ড ম্যান ফ্রম হার্ভার্ড ওয়ান্টস ভিক্টরি টুডে” এরকম(ইউটিউবে আছে, শুনে নিতে পারেন)।তবে প্রথম অংশ হচ্ছে “ডগ লাতিন” অর্থাৎ মজা করে বানানো ভুয়া ল্যাটিন ভাষায়।এই ভাষায় গানটার প্রথম লাইন হচ্ছে- “ইললেজিটিমাম নন কার্বোরান্ডাম”
(Illegitimum non carborandum) যার বাংলা ভাবানুবাদ হচ্ছে, “হারামজাদা যেন তোমাকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারে”- “Don’t let the bastard grind you down”
এই লাইনটা আমি আমার জীবনের মূলমন্ত্রের অন্যতম করে নিয়েছি। আমার ভার্সন অবশ্য এটার সাথে আরেকটা আছে, “Cunnus non carborandum”- লিঙ্গভেদে যখন যেটা যথোপযুক্ত মনের সুখে ব্যবহার করি(অর্থ বলা যাবেনা, আগ্রহীরা গুগল করে নিতে পারেন)।ইউটিউবে হাজার বার শোনা এই গানটা লাইভ পারফর্ম হতে দেখে শিহরিত হলাম- মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি!
ব্যান্ডের পারফর্মম্যান্স শেষ হবার পর শুভেচ্ছা বক্তৃতা দিতে এলেন এমআইটির প্রেসিডেন্ট রাফায়েল রেইফ।এখানে একটু বলে নেয়া ভাল, এমআইটির সাথে হার্ভার্ডের একটা অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে (ইয়েল- এর সাথে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা অলিখিত না, একেবারে সরাসরি। এটা নিয়ে আরেকদিন লিখব)। হার্ভার্ডের ছাত্রছাত্রীরা মজা করে এমআইটির ছেলেমেয়েদেরকে ডাকে নার্ড(nerd), গীক(geek), নাক কান গুঁজে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু পারেনা-এরকমভাবে।অন্যদিকে এমআইটির ছেলেমেয়েরা হার্ভার্ডকে পঁচায় পার্টি স্কুল বলে- বড়লোকের বখে যাওয়া পোলাপাইন এইখানে আসে মৌজমাস্তি করতে- এরকম একটা ব্যাপার স্যাপার।
এমআইটির প্রেসিডেন্ট পুরো বক্তৃতাতেই মনের সুখে হার্ভার্ডকে আকারে ইঙ্গিতে পঁচিয়ে
এমআইটির গুণগান গাইলেন। তাঁর বক্তৃতার সারমর্ম ছল এরকম- “ব্যাটা ল্যারি, এমআইটি তোকে তৈরি করেছে- হার্ভার্ডকে দেখেশুনে রাখিস, ইজ্জত ডুবাইস না।“
হার্ভার্ডকে নিয়ে এক একটা পঁচানি দেন প্রেসিডেন্ট রেইফ, আর সামনে বসা হার্ভার্ডের সব ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকরা হেসে ওঠে।অদ্ভুত একটা ব্যাপার! বক্তৃতা শেষে তিনি এমআইটির মূল গম্বুজের এক টুকরো পাথর দিয়ে তৈরি একটা স্মারক উপহার দিলেন সদ্য অভিষিক্ত প্রেসিডেন্টকে।
ক্লাস থাকায় পুরো অনুষ্ঠান দেখতে পারিনি, এটুকু দেখেই চলে এলাম।এই অনুষ্ঠানে যোগদানের সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছে- এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা আমাকে কেনেডি স্কুলের একটা ছোট পতাকা ধরিয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি অভিষেক অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন? উনি বললেন হ্যাঁ, তুমি যেতে চাইলে আমার সাথে যেতে পারো। আমি যেহেতু চিনিনা ভালভাবে, সানন্দে রাজী হলাম।
গুরুদেব সাব্বির আহসানের প্রোফাইল যারা অনুসরণ করেন তারা জানেন, উনি নিয়মিতই হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স দেন। এই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে জানলাম, উনার নাম হলি উইকস- গত চল্লিশ বছর ধরে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিকেশন পড়াচ্ছেন। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর পারসুয়েসিভ কমিউনিকেশনের যে বইটা, সেটার অন্যতম লেখক তিনি। সাতষট্টি বছর বয়স, অথচ কি সজীব মস্তিষ্ক- কি হাসিখুশি ব্যক্তিত্ব!
এধরণের মানুষ দেখলে আমি একটা প্রশ্ন করি- “আচ্ছা, জীবনের এ পর্যায়ে এসে যদি আপনার যাবতীয় জ্ঞান মাত্র এক লাইনে আপনার সন্তানকে দিতে বলা হয়- কি বলবেন তাকে?” মৃদু হেসে তিনি বললেন- “আমি বলব, দয়ালু হতে, মানুষের প্রতি আন্তরিক হতে”।
এই ভদ্রমহিলা আমেরিকার বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানিতে এক একটা কমিউনিকেশন ওয়ার্কসপের জন্য হাজার হাজার ডলার চার্জ করেন- এই ফিল্ডে তিনি নেতৃস্থানীয়দের একজন। হাসিমুখে আমার পাশে বসে আছেন, কিশোরীর উচ্ছ্বাসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ব্যান্ড মিউজিকের তালে মাথা দোলাচ্ছেন, আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।এরকম একজন রিসোর্স পারসন আমার পাশে, এই সুযোগ কি ছাড়া যায়? জিজ্ঞাসা করলাম, “ম্যাডাম, আমি মাঝে মাঝে প্রচণ্ড রেগে যাই এবং আমার রাগ যৌক্তিক কারণেই হয়।এরকম অবস্থায় কি করব?” উনি বললেন- এ অবস্থায় তোমার একটায় করনীয়- “Walk Away”- সরে আস ওখান থেকে।তোমার হয়ত মনে হবে ওই ব্যাটা পার পেয়ে গেল- ব্যাপারটা তা না। কেউ প্রচণ্ড রেগে যাবার মত কাজ করলে যদি তাকে শায়েস্তা করতে চাও সত্যি সত্যি- সেটা তুমি করবে ক্যালকুলেটিভ উপায়ে, ঠাণ্ডা মাথায়। ওকে রেগেমেগে দুটো কথা শুনিয়ে আসলে এক দিক দিয়ে তোমার মন মেজাজ খারাপ হবে, আরেক দিকে ওই বদমায়েশটাও শুধু কথার উপর দিয়ে পার পেয়ে যাবে। তার চাইতে সরে আসো, তারপর ওকে বুঝিয়ে দাও কার সাথে লাগতে এসেছে। হি উইল নট নো হোয়াট হিট হিম।
এইটা বাংলাদেশ হলে ভদ্রমহিলার পা ছুঁয়ে সালাম করতাম, এইখানে তো আর তা সম্ভব না। হাত ধরে কৃতজ্ঞতাবশতঃ মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে চলে এলাম ক্লাস করতে।
চলে আসার সময় অনুষ্ঠানের লিফলেট নিয়েছিলাম একটা- ওটায় চোখ বুলিয়ে একটা নাম দেখে হতবাক হয়ে গেলাম- রাকেশ খুরানা, ডীন, হার্ভার্ড কলেজ।
আমি তো যাই গ্রাজুয়েট স্কুলে, কিন্তু হার্ভার্ডের প্রাণ হচ্ছে এর আন্ডারগ্রাজুয়েট স্কুল। এই স্কুলের ডীন একজন ভারতীয় আমেরিকান! গুগল করে দেখি- ভদ্রলোকের বয়েস মাত্র পঞ্চাশ, জন্মেছিলেন ভারতে- সাত বছর বয়েসে তিনি পরিবারের সাথে আমেরিকা আসেন। ভারত থেকে আসা সেই সাত বছরের ছেলেটা আজ আমেরিকার সবচাইতে প্রেস্টিজিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরাস্বরূপ কলেজের ডীন।
আমরা বাংলাদেশিরাও একদিন হবো- কেন জানি জেদ চেপে গেলো মনের ভেতর।
পরিশেষে একটা কথা বলি। হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট যিনি হলেন, তিনি তাঁর আন্ডারগ্র্যাডটাও হার্ভার্ডে করেননি, করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুল এমআইটিতে। এটা তাঁর হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট হতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষ্ঠানের শুরুতে এমআইটির প্রেসিডেন্ট আকারে ইঙ্গিতে সবার সামনে হার্ভার্ডকে লঘু করে এমআইটিকে তুলে ধরেছেন-কেউ এতে “জাত গেলো জাত গেলো” বলে রব তোলেনি। অথচ আমাদের দেশে আমরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে গেলে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানারকম বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। আমার বাবা মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলেন দুজনই। দেশের ইতিহাস গড়ে দেয়া প্রাণপ্রিয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের যদি একটা কোর্সও কখনো পড়াতে পারতাম হার্ভার্ডে পড়াশোনা শেষ করে, ধন্য হত আমার হার্ভার্ড আসা। বিশ্বাস করুন, একটা পয়সা নিতাম না। এই সম্মান পয়সা দিয়ে মাপা যায়না, আর্থিক মূল্যের অনেক ঊর্ধ্বে এটা।
এই স্বপ্ন পূরণ হবার সম্ভাবনা খুব কম।
সেলফ হেল্প বইগুলো থেকে নেয়া একটা জনপ্রিয় গল্প বলি।
বিশাল সাইজের ভ্রমর দেখেন না মাঝে মাঝে? এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে?
এ্যারোডায়নামিক্সের সূত্র অনুসারে এর উড়তে পারার কথা না, কারণ তার ওজনের সাথে ডানার সামঞ্জস্য একটু ঝামেলাপূর্ন।
কারণ কি জানেন?
কালো ভ্রমর এ্যারোডায়নামিক্সের সূত্র জানেনা, তাই সে উড়ে বেড়াচ্ছে মনের সুখে।
আমিও স্বপ্ন দেখি, এখানে অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের তরুণতম ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে- সেই সাথে শিখছি ওদের কাছ থেকেও।
আহ!
পরিশিষ্টঃ
১) টেন থাউজেন্ড ম্যান ফ্রম হার্ভার্ড
https://youtu.be/YNixwRdiug0
২) রাকেশ খুরানা
https://news.harvard.edu/…/a-dream-quietly-imagined-come-t…/
৩) এমআইটি প্রেসিডেন্টের স্পিচ
http://president.mit.edu/…/inauguration-larry-bacow-29th-pr…