পর্ব ৪ঃ খাবারের লোভ প্রসংগে

প্রিয় স্বপ্নযোদ্ধারা,

কেমন যাচ্ছে একমাসের লড়াইয়ের তৃতীয় দিন? ভাত আর চিনিজাতীয় খাবার খেতে প্রচন্ড ইচ্ছে করছে? পড়তে থাকুন!

ফিজিকাল ফিটনেস আর ডায়েটের উপর যতগুলো বই পড়েছি, তার প্রায় সবগুলোতেই একটা কথা বলা আছে- আপনি কি খাচ্ছেন এটার উপর আপনার ফিটনেসের আশি থেকে নব্বই ভাগ নির্ভর করে।বাকি দশ থেকে বিশ ভাগ হচ্ছে এক্সারসাইজ। আর হ্যাঁ, বিশ্রাম তো অতি অবশ্যই জরুরী!

একশ চার কেজি ওজনের কুৎসিৎ ভুঁড়িবাহী আনফিট থেকে একটা মোটামুটি ফিট অবস্থায় ( ছিয়াশি কেজি) আসতে আমাকে চার থেকে আট সপ্তাহ কঠোরভাবে ডায়েট কন্ট্রোল করতে হয়েছে, সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয়দিন প্রতিদিন ফিজিকাল এক্সারসাইজ করতে হয়েছে। আজ খাবার সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতাগুলো বলব।

এই ফেসবুক প্রোফাইল যাঁরা ফলো করেন তাঁরা অনেকেই জানেন, আমি খেতে কি পরিমাণ ভালবাসি।জানুয়ারি ৬, ২০১৬ পর্যন্ত আমি বাঁচার জন্য খেতাম না, খাবার জন্যে বাঁচতাম। স্রষ্টা জন্ম দিয়েছেন সাধারন ঘরে কিন্তু জিহবা দিয়েছেন রাজা বাদশাহের- আমি খেতে ভালবাসি এবং সব খাবারই হচ্ছে “রিচ ফুড”। দেশে থাকতে পোলাও, কাচ্চি, মোস্তাকিমের চাপ, গরুর কালো ভুনা তো আছেই, সেই সাথে আম্মুর বানানো চকলেট ক্রিম কেক, কাস্টার্ড, রাজশাহী মিষ্টান্ন ভান্ডারের প্যাঁড়াসন্দেশ, সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারীর সরপুরিয়া কিংবা কুমিল্লার রসমালাই- উফ, বলতেই জিভে জল এসে যাচ্ছে! আর জাপানে আমার সুশি আর ইয়াকিনিকুর বর্ণনা সংক্রান্ত ছবি তো দেখেছেনই!

প্রবাসে আমার আরেকটা অসুবিধা হচ্ছে, রান্না করতে একেবারেই জানিনা, ফলে নির্ভর করতে হয় নীচের সুপারমার্কেটগুলোর উপর। ওখান থেকে কিনে আনি কোক, কিটক্যাট, স্নিকার্স, টুনা স্যান্ডউইচ, ক্রীম কেক ইত্যাদি। ভার্সিটির পাশে সানি ভাইয়ের বিরিয়ানির দোকান আসার পর মনে হয় তিন বেলাই বিরিয়ানি খেতাম!

একশ কেজি থেকে আট সপ্তাহে ছিয়াশি তে নেমে আসতে আমার সবচেয়ে বড় বাধা ছিল খাবারের প্রতি এই প্রচন্ড নেশা। এখানে ক্রাভ মাগা নামক সেলফ ডিফেন্স ক্লাসে এক ঘন্টা পাঞ্চিং ব্যাগ ওয়ার্ক আউটে আপনাকে মোটামুটি মেরে ফেলবে, আর্মি আর পুলিশ দুটো ট্রেনিং মিলিয়েও এক ঘন্টার মধ্যে এত কঠিন ট্রেনিং মনে হয়না করেছি।তবুও দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বিরিয়ানির লোভ সামলানোর চাইতে ওই ট্রেনিং করা অনেক সহজ।

এমন বহুদিন গিয়েছে, দুপুর বেলা বিরিয়ানির দোকানের সামনে গিয়েছি- ঘ্রাণ নিয়েছি, তারপর আস্তে করে পাশের দোকান থেকে সালাদ আর টুনাফিশ কিনে খেয়েছি।সেভেন ইলেভেনে গিয়ে কিটক্যাট বার হাতে নিয়েছি, তারপর ৪১২ কিলোক্যালরি লেখা দেখে আবার হাত থেকে নামিয়ে রেখেছি। এই কাজগুলো সিলি মনে হতে পারে, কিন্তু করা কতটা কঠিন এটা যে করেনি সে কখনো বুঝবে না।

হাই ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং বলে একটা এক্সারসাইজ মেথড আছে ( পরের পর্বে বিস্তারিত লিখব), দশ মিনিট থেকে আধ ঘন্টার মধ্যে আপনার জিহবা বের করে দিবে। প্রথম দুই মিনিট আস্তে জগিং, তারপর এক মিনিট সর্বশক্তিতে স্প্রিন্ট, তারপর আবার দুই মিনিট আস্তে জগিং- এভাবে বিরতি দিয়ে দিয়ে ( ইন্টারভাল) দৌড়। আমি এটা মাঝে মাঝে করতাম যেদিন ক্রাভ মাগা ক্লাস মিস যেত। ট্রেডমিলে বিশ মিনিট এটা করলে তিন কিলোমিটারের মত দৌড় হয়, আর ক্যালোরি খরচ হয় দুইশ এর একটু বেশি। আর শেষ করার পর মনে হয় আপনি মারা যাচ্ছেন- হার্টবীট ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবার মত অবস্থা হয়। এই লেভেলের পরিশ্রম করার পর মাত্র খরচ হয় দুইশ ক্যালোরি, আর একটা কিটক্যাট চকোলেট বার খেলেই আমি শরীরে ভরছি ৪০০ এর বেশি ক্যালোরি, এক প্লেট বিরিয়ানিতে আটশ থেকে বারোশ ক্যালোরি এক বসাতেই। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষের দিনে ১৪০০ ক্যালোরি লাগে, আর এক প্লেট বিরিয়ানিতেই থাকে হাজারের উপর। আপনার শরীরের প্রয়োজন মেটার পর বাকি যে ক্যালোরি, এগুলো জমা হয় ফ্যাট আকারে- এই হচ্ছে কনভেনশনাল নলেজ। এত পরিশ্রম মাত্র একটা কিটক্যাটের লোভে পানিতে ফেলব- এটা যখন ভাবতাম, তখন আর ওই চকোলেট মুখে রূচত না।

দিনে চব্বিশ ঘন্টাও যদি ব্যায়াম করেন, কোন লাভ নেই যদিনা খাবার ঠিকঠাক খান। সিলেটে দুসপ্তাহের কাউন্টার টেরোরিজম শর্ট কোর্সে গিয়েছিলাম নব্বই কেজি ওজন নিয়ে। বাংলাদেশ আর্মি স্পেশাল ফোর্সের বাঘা বাঘা সব ইন্সট্রাকটররা আমাদেরকে দু সপ্তাহে মোটামুটি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলেন- গায়ের রঙ পুড়ে চেনাই যেতনা কাউকে।ফিরে এসে ওজন মেপে দেখি এক কেজিও কমেনি।

কেন জানেন?

অনেক চিন্তা করে বের করলাম,ট্রেনিং শেষ করে সাত আট গ্লাস প্রচুর চিনি দেয়া স্পেশাল লেবুর শরবত খেতাম ডায়নিং হলে, সেই সাথে তিন-চার প্লেট ভাত।অমানুষিক পরিশ্রম করেও ওই এক্সট্রা ভাত আর চিনির প্রভাব দূর করতে পারিনি, ওজন এক জায়গায় স্থির রয়ে গিয়েছিল- কারো কারো এক দু কেজি বেড়েছিলোও।

কাজেই, যতই লোভনীয় লাগুক- চিনি আর কার্বোহাইড্রেটকে শত্রু বলে মনে করুন।
থমাস মফেটের ভাষায় বলি, দাঁত দিয়ে নিজের কবর খুঁড়বেন না।

আজকাল মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়েসি ছেলেমেয়েরা হার্ট এটাক করে ধুম করে মারা যায়, হাই প্রেশার/ডায়বেটিকসে পেয়ে বসে ত্রিশ ছুঁই ছুঁই তরুন তরুনীদের। অকালে বুড়িয়ে যায় বেশিরভাগ মানুষ। ওজন নিয়ন্ত্রণে না রাখা এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের সাথে প্রায় সব ধরণের রোগ বালাইয়ের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। কাজেই, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিয়মিত এক্সারসাইজ করা কোন বিলাসিতা নয়- খাওয়া ব ঘুমের মত এটাও হওয়া উচিত আপনার পার্ট এ্যান্ড পার্সেল অফ লাইফ।

এ সিরিজের প্রথম দু পর্বে মোটামুটি বলে দেয়া আছে কি খাবেন এবং কি করবেন, আমার টাইম লাইনেই পাবেন। যাঁরা ইতোমধ্যেই আমার সাথে খাবার নিয়ন্ত্রণ এবং এক্সারসাইজ করার ত্রিশ দিনের এই যাত্রায় শামিল রয়েছেন তাঁদের বলি- লড়াই জারি রাখুন!

আমি এপ্রিলের আট তারিখ এক মাসের যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আছি আপনাদের সাথে, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান আর সামর্থ্য নিয়ে।আজ শেষ করছি প্রিয় একটি উক্তি দিয়েঃ

Suffer the pain of discipline or suffer the pain of regret. The choice is yours, O dreamer!

 

প্রথম প্রকাশিতঃ ১০ই মার্চ, ২০১৬

Comments

comments