শৈশবস্মৃতি: বই (প্রথম পর্ব)

 

আমার বাবা ভয়াবহ বইপাগল লোক। ছোটবেলায় দেখতাম, একেকবার একেক বিষয় ধরতেন এবং সে বিষয়ে যা যা পড়াশোনা সম্ভব বই কিনে নিজেই পড়ে ফেলতেন। কখনো আইন, কখনো পাখি, কখনো উদ্ভিদবিদ্যা, কখনো বা দর্শন। তাঁর বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতেই বই পড়া শুরু, যদিও কিছুই বুঝতাম না।

মা ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, বাসায় তাঁর পাঠ্যবইগুলো থাকত। শেকসপীয়ারের নাটক থেকে গল্প- এ বইটা পড়ে সর্বপ্রথম পরিচিত হই হ্যামলেট আর ম্যাকবেথের সাথে। রামজি লালের নোটবইগুলো তখন দেখতাম, ইংরেজি পড়তে না পারায় বুঝতাম না। তবে প্যারাডাইস লস্ট, গালিভারস ট্রাভেলস, ড: ফস্টাস- এ বইগুলোর সাথে মায়ের মাধ্যমেই পরিচয়, বড় হয়ে পড়েছি।

আমার প্রথম পড়া গল্পের বই “বোতল ভূত”, বইমেলা থেকে মা এনে দিয়েছিলেন। বোতলের ভেতরে আটকে পড়া এক ভূত বড়দের অত্যাচার থেকে ছোট বাচ্চাদের রক্ষা করছে, পড়ে কি ভালই না লাগত! দ্বিতীয় বই হচ্ছে টুকুনজিল, জাফর ইকবাল স্যারের লেখা। পৃথিবীর একদিকে বই আর আরেকদিকে বাকি সবকিছু, এই ছিল আমার অবস্থা। এর পর একে একে পড়লাম কপোট্রনিক সুখ দু:খ, ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম- সায়েন্স ফিকশনের জগৎ খুলে গেল। মানব বিজ্ঞানীর আধা রবোট স্ত্রী বুলার কষ্ট প্রাণ ছুঁয়েছিল, খুব মনে পড়ে।

প্রচুর ছবিওয়ালা একটা ঈশপের গল্পের বই এনে দিয়েছিলেন বাবা, সারাদিন পড়তাম সেটা। সাথে ছিল নন্টে ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা, খাঁদু ও তার বৈজ্ঞানিক দাদু – নারায়ণ দেবনাথের অমর সব সৃষ্টি। বাতিঘর থেকে গতবছর তাঁর তিন খণ্ডের কমিকস সমগ্র কিনেছি, পুরোন আবেদন একটুও মলিন হয়নি। এখনও নন্টে ফন্টের কেল্টুদাকে সাইজ দেয়ার বিচিত্র সব উপায় দেখলে খিলখিল করে হাসি, ফিরে যাই আমার হারানো শৈশবে।

ডায়মন্ড কমিক্সের চাচা চৌধুরী ,বিল্লু, পিঙ্কী ছিল সবচাইতে প্রিয়। ছোটবেলাতেই স্বাভাবিকের চাইতে লম্বা ছিলাম, সবাই সাবু বলে ডাকত
( বিএমএ তে সার্জেন্ট মোহাম্মদ স্যারও একই নামে ডাকতেন, জানিনা তিনি কেমন আছেন। এতদিনে মেজর হয়ে যাবার কথা)।

আর প্রিয় ছিল ফ্যান্টম। আফ্রিকার গহীন জঙ্গলের খুলিগুহায় চলমান অশরীরীর দুর্ধর্ষ সব অভিযান, ঘোড়া তুফান আর কুকুর বাঘা, জঙ্গল রক্ষীদল- এক অদ্ভুত জগতে নিয়ে যেত আমাকে। বাবা বনবিভাগে চাকরি করতেন দেখে নিজেদের বাসাটাকেই খুলিগুহা বানিয়েছিলাম , কুকুর সনিকে বাঘা বলে ডাকতাম। সুইম স্যুট পরিহিতা ডায়ানা পামার আমার শৈশবের প্রথম প্রেমে পড়া নারীচরিত্র। মাসখানেক আগে লন্ডনে ডায়ানা নাম্নী এক তরুনীর সাথে পরিচয় হয়েছিল। ওকে “মিস পামার” বলে ডাকতাম। মজার ব্যাপার, ফ্যান্টমের সাথে সে-ও পরিচিত, আমার ডাক ফিরিয়ে দিত “মি: ওয়াকার” বলে!

ফ্যান্টমের আরো দুটো নাম ছিল, “বেতাল” এবং “অরন্যদেব”। শিশির ভাইয়া আর শিরিন আপুর কাছ থেকে বইগুলো নিতাম। শিশির ভাইয়া একটা ব্যাঙ্কে আছেন, আর শিরিন আপু কোন এক অজানা অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। পুলিশে থাকায় তাঁদের বাসায় আমি গিয়েছিলাম ঝামেলা সামলাতে। ইচ্ছে করেই লাশের মুখ দেখিনি, বই হাতে আমার অন্তরে তাঁর ওই হাসিমুখটাই শেষ স্মৃতি হয়ে রয়েছে।

সেবার সাথে পরিচয় ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস দিয়ে, মেরুবিজয়ে একরোখা ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের অসামান্য অভিযানে সঙ্গী হয়েছিলাম সেই ছেলেবেলাতেই।
তিন গোয়েন্দার চাইতে গোয়েন্দা রাজুকেই বেশি ভাল লাগত কেন জানি। কিশোর ক্লাসিক “আ টেল অফ টু সিটিজ” পড়ে সর্বপ্রথম কেঁদেছিলাম, সিডনি কারটনের জন্য। মফস্বলের এক কিশোরের চোখে যে স্বপ্নের জগৎ কাজীদা খুলে দিয়েছিলেন তাঁর সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে, এই ঋণে আমি আমৃত্যু নিমজ্জিত থাকব। শত আঁতেলের নাক সিঁটকানোতেও কিচ্ছু যায় আসে না। ও হ্যাঁ, মাসুদ রানার আমার পড়া প্রথম বই “রক্তের রঙ”, দীপু খালার কাছ থেকে চুরি করে। বড়দের উপযোগী অনেক কিছুই বুঝিনি তখন, কিন্তু রানার এ্যাডভেঞ্চারে শিহরিত হয়েছি। সেই মুগ্ধতা অবসেশনে রূপ নিয়েছিল “অগ্নিপুরুষ” পড়ে, যার কথা এর আগে অন্য একটি লেখায় বলেছি। মাসুদ রানা আজও আমার হিরো, টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায়না।

আম্মুর ক্লাসমেট মনির মামা দিয়েছিলেন আলেকজান্ডার বেলায়েভের “উভচর মানব”, ইকথিয়ান্ডারের হারিয়ে যাওয়াতে বুক ভেঙে গিয়েছিল। রাদুগা প্রকাশনীর আরেকটা বই “চুক আর গেক” খুব মনে পড়ে, আরও মনে পড়ে আলেক্সেই তলস্তয়ের “বুরাতিনো আর তার বন্ধুরা”। রাশিয়ার ল্যাবমেট স্টাসকে এগুলোর কথা জিজ্ঞাসা করলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, আর আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি একটা!

চীনের বানর দেবতা শুন উখোংকে নিয়ে ছবির বই “স্বর্গরাজ্যে তোলপাড়” বইটা প্রচন্ড দাগ কেটেছিল মনে। স্বর্গের দেবতাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরূদ্ধে মর্ত্যের বানরের বিদ্রোহ ভীষণ আলোড়িত করেছিল আমাকে। বিশাল পৃষ্ঠাজুড়ে দারুণ সব ছবি, নীচে ছোট্ট করে লেখা দুচারটি লাইন। কি মোহাচ্ছন্নই না করে রাখত আমাকে!

ছোটদের বিশ্বকোষ নামে ছয় খণ্ডের একটা এনসাইক্লোপিডিয়া টাইপ বই বাবা কিনে দিয়েছিলেন, যেটা বিশ্বের ইতিহাস, ভূগোল , দর্শন, পূরাণ , বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সারকথা গল্প আকারে ব্যাখ্যা করত। সেই ছেলেবেলা থেকে বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত এই বইটা আমাকে সহায়তা করেছে। তবে এ বইতে একটা ভুল ছিল, মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় সেনাদের “সহায়ক” বলে দাবী করেছিল বইটি। বাবাকে দেখিয়েছিলাম, বাবা লাল কলম দিয়ে সে জায়গাটুকু কেটে দিয়েছিলেন। জানিনা, এখনকার কিশোরদের জন্যে এমন বই আছে কিনা।

ঠাকুরমার ঝুলি, কাজী আবদুল আলিমের “দেশ বিদেশের রূপকথা”, “চিলড্রেন এপিকস” এর রামায়ন মহাভারত ইলিয়াড ওডেসি , দাদীর কাছ থেকে চুরি করে পড়া “মোখসেদুল মোমেনিন”, “বিষাদ সিন্ধু” কিংবা কবি গোলাম মোস্তফার “বিশ্বনবী” , ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত কমিক্স “টিপু সুলতান” , “বাদশাহ আলমগীর” , “তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা”, “ফকির মজনু শাহ”- কি অপূর্ব সব বই!

ক্লাস সেভেনে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার পর কলেজ লাইব্রেরি দেখে মনে হয়েছিল মাছিকে মিষ্টির দোকানে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বারো বছরের এক কিশোরকে এক ভিন্ন পৃথিবীর সাথে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিল ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ কেন্দ্রীয় পাঠাগার, যে পৃথিবীতে অনুরনন তুলেছিলেন ইংরেজির আজিজ স্যার এবং বাংলার দীনেশ স্যার। পিতার কাছে আমি জন্মের জন্যে ঋনী, আর এ দুজনের কাছে মানবজন্মের জন্যে। আরও একজনের ঋণ কখনো শোধ হবেনা, তিনি হচ্ছেন দীপু খালা- যাঁকে ছোটমা বলে ডাকি। আমার বই পড়ার নেশার খোরাক যোগাতে প্রতিনিয়ত নিজের ভার্সিটির হাতখরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে “জ্ঞানকোষ” এবং “বই বিচিত্রায়” নিয়ে যেতেন, কিনে দিতেন “রবিনসন ক্রুসো” বা এমন কোন বই। কখনো মুখ ফুটে বলিনি, আজ প্রকাশ্যে তাঁর অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে বের হবার পর চারশ টাকা দিয়ে একদিন সাহস করে জ্ঞানকোষ থেকে কিনে ফেললাম মারিও পূজোর “দি লাস্ট ডন”। ওটাই প্রথম ইংরেজি বই, সাহস করে পুরোটা পড়ে শেষ করে মনে হল বিশ্বজয় করে ফেলেছি! আমার শৈশবের বইপড়া এ বইটার মাধ্যমেই তারুণ্যে পদার্পন করেছিল, সেই পাঠক সত্তা আজও সৌভাগ্যক্রমে মরে যায়নি। উত্তরা বা গুলশানে আমার অফিসে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা জানেন, একগাদা বইয়ে থানার ওই রূম ভর্তি থাকে। সচলের নজু ভাই তো মুখ ফুটে বলেই ফেলেছিলেন, “ওই মিয়া, পুলিশের রূমে এইসব কি”!!

বই আমার ক্ষুধার খাদ্য, তৃষ্ণার পানীয়, যৌনকামনার প্রিয় সঙ্গিনী, বিপদের বন্ধু, আমার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বই। এ কারণে খাগড়াছড়ির দূর্গম মুসলিমনগর ক্যাম্পে বসেও নি:সঙ্গতায় ভুগিনি কখনো, সঙ্গলাভ করেছি যুগস্রষ্টা সাহিত্যিকদের। কত বই পড়ার আছে অথচ এক জীবনে এত বই পড়ার সময় কোথায়? তারাশঙ্করবাবুর “কবি”র মত প্রায়ই শুনতে পাই নিজের হাহাকার: “জীবন এত ছোট ক্যানে?”

প্রিয় পাঠক, বই নিয়ে আমার প্রিয় তিনটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি:

1) A man who reads books never sleeps alone. Non-readers live just one life but a reader lives a thousand lives!

2) A child who reads today is a man who thinks tomorrow.

3) I need three things to survive this life: Books, books and books.

আপনার শিশুকে যেভাবে পারেন বই পড়ার মজাটা পাইয়ে দিন, ব্যস, অভিভাবক হিসেবে আপনার আর কোন চিন্তা নেই- এ শিশু মানুষ হবেই!

( চলবে )

Comments

comments