দি সাইকেল অফ এ্যাবিউজ বা অপব্যবহারের দুষ্টচক্র: সপ্তম পর্ব-নিপীড়কের হাত থেকে বাঁচতে কি কি করবেন?

#প্রথম_অংশঃএকলা_চলো_রে ( অনিতা রহমান)

ইমোশনাল এ্যাবিউজ এমন এক ব্যাধি, নিজে এর শিকার না হলে অনুধাবন করা প্রায় অসম্ভব। এর প্রধান কারণ হলো নিপীড়কের নির্যাতন পদ্ধতি,যেটি দ্বিতীয় পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। আবেগীয় নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে আসার পথে প্রধান অন্তরায় হলো ট্রমাটিক বন্ডিং বা পীড়ামূলক বন্ধন (২য় পর্ব দ্রষ্টব্য-http://tinyurl.com/oedru8d )

যে মুহূর্তে নির্যাতিত ব্যক্তি এই বন্ধনের শৃঙ্খল ভাংতে পারবেন, তিনি নিজেকে মুক্ত করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন। এই কাজটি করার জন্য সর্বপ্রথম নিপীড়িতের নিজেকেই কিছু আত্মশুদ্ধিমূলক কৌশল পালন করতে হবে, যা “এ্যাভালাঞ্চ অফ সোল” ব্লগে বলা হয়েছে। এই উপযোগী পদক্ষেপ গুলোকে একটি তালিকা আকারে সাজানো যেতে পারে, নিম্নরূপে—

১. #নো_কন্টাক্ট_তথা_যোগাযোগ_বিচ্ছিন্নকরণঃ প্রথম ধাপ হিসেবে নো কন্টাক্ট বা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরন কে ধরা হয়। এক্ষেত্রে খুব কার্যকরী পদ্ধতি হলো “লেট মি রীচ” (http://letmereach.com/) ব্লগের লেখিকা ও প্রফেশনাল রিলেশনশীপ কোচ কিম সাঈদ (Kim Saeed) কর্তৃক প্রস্তাবিত “নো কন্টাক্ট চ্যালেঞ্জ”-এর প্রয়োগ। এই পধতিতে “নো কন্টাক্ট” বলতে বুঝায়—

নিপীড়ক-কে ফোন থেকে ব্লক করা, তার পাঠানো সকল মেসেজ, ভয়েসমেইল ইত্যাদি মুছে ফেলা, এবং মুছে ফেলার আগে সেগুলো না খোলা,নিপীড়ক-কে ইমেইল একাউন্ট থেকে ব্লক করে দেওয়া, ইচ্ছে হলে ব্লক করার আগে তাকে শেষ বারের মত ইমেইল করে জানিয়ে দেয়া যে তাকে ব্লক করা হচ্ছে, তবে ইমেইল না করাটা-ই ভাল। নিপীড়ক-কে সকল সোশাল একাউন্ট থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া যাতে সে কোনভাবেই যোগাযোগ বা নজরদারি করতে না পারে বা নিপীড়িত ব্যক্তি-ও নিপীড়ক সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার সুযোগ না পায়। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষ থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা উচিত যাতে কেউ কারো সম্পর্কে অনুসন্ধান করে অযথা যোগাযোগের অলিখিত পথ খোলা রাখতে না পারে।

সম্ভব হলে ফোন নম্বর পালটে ফেলা উচিত এবং নতুন নম্বর বিতরনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত। ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসী মানুষ ব্যতীত নতুন নম্বর অন্য কাউকে না প্রদান করাই শ্রেয়।

নিপীড়ক বাসা পর্যন্ত ধাওয়া করলে, তাকে কোনভাবেই ভেতরে আসতে দেয়া উচিত নয়। যদি তার কাছে থেকে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তবে প্রয়োজনীয় পুলিশি/আইনী সাহায্য গ্রহন করে তাকে প্রতিহত করা উচিতীক্ষেত্রে থানায় জিডি করা যেতে পারে। জিডি করার পর সংশ্লিষ্ট অফিসারের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখাটা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ।

নিপীড়কের থেকে আসা চিঠিপত্র ইত্যাদি অন্য কোন বিশ্বস্ত মানুষকে দিয়ে পড়ানো, যাতে দরকারী/আইনী নোটিশ ইত্যাদি মিস না হয়ে যায়। যদি এইসব চিঠিপত্র পড়ে এটা মনে হয় যে ব্যাপারটা আসলে হুভারিং (আবেগীয় ব্যবহারের মাধ্যমে নিপীড়িতকে সম্পর্কে ফেরানোর প্রচেষ্টা), তাহলে ঐ বিশ্বস্ত বন্ধু যেন তৎক্ষনাত ঐ চিঠি নিপীড়িতের কাছে না পৌঁছিয়ে দ্রুত নষ্ট করার ব্যবস্থা করেন।
অন্য কোন বন্ধু/পরিচিতের মাধ্যমে নিপীড়িতের কোন তথ্য যেন নিপীড়কের কাছে না যায়
সোশাল একাউন্টে অপরিচিত কাউকে যুক্ত না করা, বিশেষতঃ যেসব একাউন্টে ছবি থাকে না বা সদ্য খোলা হয়।

“নো কন্টাক্ট” এর ক্ষেত্রে নিপীড়িতের যে সব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ তা হলো—

“নো কন্টাক্ট” পদ্ধতি কে প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে নিজের অস্তিত্ব, আত্মসম্মান রক্ষার উপায় হিসেবে ব্যবহার করা, যাতে একজন নিপীড়িত তার সম্পর্কের পীড়ামূলক বন্ধন ছিন্ন করে বের হয়ে আসতে পারেন।

এই পদ্ধতিতে একজন নিপীড়িত তার নিপীড়ককে কোনভাবেই যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া উচিৎ না। তাকে সম্ভব হলে ফোন থেকে পুরাপুরি-ই ব্লক করে দিতে হবে অথবা নম্বর পালটে ফেলতে হবে। যদি নিপীড়ককে কল করার সুযোগ দিয়ে রাখা হয় তাহলে হয়তোবা হুভারিং দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিপীড়িত আবার একসময় ফিরে যেতে পারে নিপীড়কের কাছে!

নিপীড়ককে নিজের সোশাল একাউন্টে রেখে তাকে নিজের স্বাধীনতা বা সুখী জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখিয়ে ঈর্ষান্বিত করাটা আসলে ভুল। আগেই বলা হয়েছে যে “নো কন্টাক্ট” পদ্ধতি কোন প্রতিশোধের হাতিয়ার নয়, কাজেই সেটাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করাই উত্তম।

“নো কন্টাক্ট” মানে নিপীড়ককে কিছুদিন অবজ্ঞা করে পরে আবার তার কাছেই ফিরে যাওয়া নয়। এটা তাকে শিক্ষা দেওয়ার অস্ত্র না বরং নিপীড়িতের নিজেকে বাঁচানোর কৌশল।

এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে নিপীড়িতের কখনোই উচিত হবে না নিপীড়কের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার চেষ্টা-ও করা, বা তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোনরূপ অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করা।
এই পদ্ধতি অনুসরনকালীন নিপীড়ককে সচকিত করে তোলা মোটেই কাম্য নয়। এমনটা করলে নিপীড়ক অযথা কিছু বিরক্তিকর নাটকীয় আচরনের সুযোগ পেয়ে যতে পারে যা কাম্য নয়।
“নো কন্টাক্ট” পদ্ধতি মানে এই নয় যে নিপীড়িত সবাইকে এই পধতি অনুসরনের সংবাদ জানিয়েও নিপীড়কের সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখবে এবং সেই সংবাদ গোপন করে যাবে।

২. #ইমোশনাল_ব্ল্যাকমেইলিং_কে_এড়ানোঃ এই ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং এর ক্ষেত্রে নিপীড়ক আত্মহত্যার হুমকি বা প্রচেষ্টা ব্যবহার করে নিপীড়িতকে সম্পর্কে আটকে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এছাড়া নিপীড়ক অন্যান্য আবেগীয় যুক্তি যেমন নিপীড়িত কে ছাড়া একাকীত্ব অনুভব করা, দুঃখ পাওয়া, ডিপ্রেশনে চলে যাওয়া ইত্যাদিকেও ব্যবহার করতে পারে। এগুলোর সবকিছুকেই আসলে সম্পূর্নরূপে উপেক্ষা করে নিপীড়িতের নিজেকে নিপীড়ক থেকে আলাদা করে ফেলা উচিৎ।

৩. #লেখালেখির_মাধ্যমে_নিজের_অভিজ্ঞতা_বর্ণনাঃ লেখালেখি একটি দারুণ প্রক্রিয়া যা নিপীড়নের আঘাত কে কাটিয়ে উঠার জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ।নিজের অভিজ্ঞতা কে লিপিবদ্ধ করে কেবল যে অন্যকে দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হবেন তা নয়, বরং নিজের আত্মউপলদ্ধির পথেও আরেকটু এগিয়ে যাবেন, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হচে পারবেন, ফিরে পাবেন হারানো আত্মবিশ্বাস। এই লেখালেখির মূলত ২ টি অংশ থাকবে। এক অংশে নিপীড়কের করা সকল অত্যাচারের বিবরণ থাকে এবং অন্য অংশে এই অত্যাচার থেকে বেরিয়ে আসার পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করা হবে। এক্ষেত্রে পীড়ামূলক বন্ধনের প্রভাব হিসেবে নিপীড়কের প্রতি নিপীড়িত যখনই মায়া অনুভব করবে, তখন এই অত্যাচারের তালিকাটি তাকে ঐ মায়ার বন্ধন কাটাতে প্রধানরূপে সাহায্য করবে। এ পদ্ধতিকে “রি-প্রোগ্রামিং” বলা যেতে পারে।

৪. #সারভাইভারদের_সাথে_স্মৃতিচারনঃ এরূপ ট্রমাটিক বন্ডিং থেকে যারা ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন, এমন সতীর্থ “সারভাইভর” দের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহন খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে নিজের মনে জমে থাকা নিপীড়ন সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর-ও সুন্দর সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়।

৫. #পরিবার_বন্ধু_ও_শুভাকাঙ্খীদের_সাথে_সম্পর্কের_পুনঃস্থাপনঃ নিপীড়িত ব্যক্তিরা সাধারনতঃ নিপীড়নের অংশ হিসবে পরিবার, বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করতে বাধ্য হয়, যাতে নিপীড়িত কোনরূপ সাহায্যের সুযোগ-ই না পায়। কাজেই পীড়ামূলক বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক পুনরূদ্ধার করাটা খুবই জরুরী। এক্ষেত্রে নিপীড়ন সম্পর্কে তাদের কে জানাতে হলে স্বচ্ছতা থাকা খুবই জরুরী যাতে প্রয়োজনীয় সাহায্য উপযুক্ত রূপে পাওয়া সম্ভব হয়। মনে রাখতে হবে যে নিপীড়নের লজ্জা নিপীড়কের, নিপীড়িতের নয়, কাজেই শুভার্থী-দের সহায়তা লাভের জন্য নিপীড়নের পূর্ণ বিবরণ কোন লজ্জিত হওয়া ছাড়াই তাদের কে অবহিত করতে হবে।

৬.#নিজেকে_খুশী_রাখাঃ একটি নিপীড়নমূলক সম্পর্ক-কে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো নিজেকে ফিরে পাওয়া। কাজেই নিজেকে ভালবেসে, নিজেকে সন্তুষ্ট রেখে সুখী থাকতে হবে। নিজের পছন্দনীয় কাজগুলো করতে হবে যা নিপীড়ক কর্তৃক এতদিন একজন নিপীড়িতের পক্ষে করে উঠা সম্ভব হয় নি। যেমন-শপিং, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, নিজের শখের কাজ ইত্যাদি।

৭. #সাফল্যের_উদযাপন_ও_সামনে_এগিয়ে_চলাঃ নিপীড়কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর প্রতিটা দিনই হয় নিপীড়িতের জন্য বিজয়ের ক্ষণ। মনে রাখতে হবে যে অসঙ্খ্য নিপীড়িত-ই এরূপ বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হন শেষ পর্যন্ত। এ ব্যাপারটা মাথায় রেখেই এগিয়ে যেতে হয় মুক্তির আনন্দকে সাথে রেখে, জীবনের দিকে। মনে রাখতে হয় যে মুক্তির এ যাত্রা হয়তো যথেষ্ট মসৃন নয়, কিন্তু তা যেন মুক্তিকামী নিপীড়িতের উদ্দীপনা-কে খর্ব করতে না পারে কোনভাবেই। এ যাত্রা নিপীড়িতের জীবনের পাথেয়, তাই এর সাফল্য উদযাপনের অধিকার-ও শুধু তারই।

#দ্বিতীয়_অংশঃসতর্কতাসমূহ (মাসরুফ হোসেন)

#একঃ রিবাউন্ডের পাল্লায় পড়বেন না- এটা হচ্ছে প্রথম সতর্কতা। রিবাউন্ড মানে হচ্ছে একটা সম্পর্ক থেকে বের হবার পর সেটা ভুলতে সাময়িক কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, সত্যিকারের অনুভূতি ছাড়াই। আপনি সদ্য একটা সম্পর্ক থেকে বের হয়েছেন- এ মুহূর্তে আপনার দরকার স্ট্যাবিলিটি, নিজের ক্ষত সারিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ানো। অন্ততঃ ছয়মাস থেকে এক বছন ন্যূনতম কোন নতুন সম্পর্কে না জড়ানোই উত্তম। বহু বদমায়েশ আছে যাদের কাজই হচ্ছে এরকম অরক্ষিত(Vulnerable) ভিকটিমকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়া। এটা হতে দেয়া যাবেনা, আমরা চাইনা আপনি ফুটন্ত কড়াই থেকে বেঁচে এসে জ্বলন্ত উনুনে পড়ুন।

#দুইঃ প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ বলে আবারও বলছি, ছেড়ে আসা বদমায়েশটাকে “হুভারিং” এর সুযোগ দেবেন না। যে মানুষটা দিনের পর দিন আপনাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করেছে, বছরের পর বছর আপনাকে পশুর চাইতেও খারাপ ভাবে ট্রিট করেছে- সেই মানুষটা যদি কাঁদতে কাঁদতে আপনার পায়ের কাছে মাথা রেখে মরেও যায়, আপনার কাজ কি হবে বলুন তো?

লাত্থি মেরে বদমায়েশটার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেয়া। আর হ্যাঁ লাত্থি দেবার পর বুট জুতোটা ভালভাবে ধুয়ে নিতে ভুলবেন না যেন!

নজরুলের কবিতা দিয়ে শেষ করিঃ

বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি ,এবার সব্যসাচী-
যা-হোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার মরে বাঁচি!

এ লেখাটি এতদূর পড়েছেন মানে আপনার হাতে জ্ঞানের অস্ত্র দেয়া হয়েছে। প্রয়োগ করুন এটা, বিজয় অথবা বীরগতি!!!


Comments

comments