দি সাইকেল অফ এ্যাবিউজ বা অপব্যবহারের দুষ্টচক্র: চতুর্থ পর্ব

কিভাবে বুঝবেন নিপীড়ক হাতিয়ার হিসেবে সেক্সকে ব্যবহার করছে?

(এ্যাভালানশে অফ দা সোল ওয়েবসাইটে এই চমৎকার আর্টিকেলটি পেলাম। ওয়েবসাইটটিকে পূর্ণ কৃতিত্ব দিয়ে আপনাদের সুবিধার্থে ভাবানুবাদ করছি)

আপনার কি মনে হচ্ছে সেক্সের ব্যাপারে আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই? বিছানায় যা হয়ে এতে কি আপনার কোন মতামত দেবার অধিকার নেই? আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী কি আপনাকে এমন কিছু করতে বলে যা আপনার জন্যে প্রচন্ড অস্বস্তিকর?

এরকম যদি হয়, আপনি খুব সম্ভবত নিপীড়িত হচ্ছেন, যেখানে সেক্স হচ্ছে একটা হাতিয়ার। এ বিষয়গুলোকে আমাদের দেশে ট্যাবু করে রাখা হয়। বিশেষ করে মেয়েরা তাদের যৌনতার ব্যাপারে পছন্দ অপছন্দের কথা জানাতে চাওয়া মানে ধরেই নেয়া হয় তার “চরিত্র” খারাপ।

সময় এসেছে এই অসুস্থ্ সামাজিক রীতিনীতি ছুঁড়ে ফেলবার। আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী সেক্সকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কিনা তা বোঝার তিনটি উপায় আছে, যা বিস্তারিত বর্ণনা করছিঃ

“তুমি মরা মানুষের মত শুয়ে আছ”

ডঃ হুমায়ূন আজাদ তাঁর নারী বইটিতে বলেছিলেন, “বাংলাদেশে একজন বিবাহিতা নারীকে যতবার নিজের ইচ্ছার বিরূদ্ধে সঙ্গম সইতে হয় তা সম্ভবত একজন পতিতার চাইতেও বেশি”

আপনার সঙ্গীর ইচ্ছে হওয়া মাত্রই আপনাকে সাড়া দিতে হচ্ছে- তাতে আপনার যতই শরীর খারাপ, অস্বস্তি, মানসিক অবস্থা খারাপ হোক না কেন।খুব কাছের এক বান্ধবীর অকাল মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন- আপনার পাষণ্ড সঙ্গীটি ঠিক ওই অবস্থায় আপনাকে টেনে ধরে বলল, “আসো, সব ঠিক করে দিচ্ছি”।

তার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে আপনি যখন পোশাক খুলে নিজেকে উন্মুক্ত করলেন, সে আপনার চোখের পানির দিকে একবার তাকালোও না- শুধু খোঁচা দিয়ে উঠল, “এরকম মড়ার মত পড়ে আছো কেন?”

সেক্স একটি স্বর্গীয় আনন্দের ব্যাপার, যদি এটি পারস্পরিক সম্মতিতে এবং বোঝাপড়ার ভিত্তিতে হয়। যদি একপক্ষের কোন কথা বলার সুযোগ না থাকে, সেক্ষেত্রে ওই সেক্স মৃত্যুর চাইতেও ভয়াবহ। এটাকে বলা হয় ম্যারিটাল রেইপ( এ প্রসঙ্গে আলাদা একটিও লেখা আছে যা পরবর্তীতে দেয়া হবে)।

সেক্সকে হাতিয়ার বানিয়ে আপনার উপর নিপীড়ণ করা হচ্ছে- এটা বোঝার প্রথম লক্ষণ হল সেক্স কখন, কিভাবে কতবার হবে এতে আপনার বিন্দুমাত্র মতামত দেবার অধিকার না থাকা। আপনিও যে একজন রক্তমাংসের মানুষ, আপনারও যে ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে পারে- এটা একজন নিপীড়ক পার্টনার কখনোই বুঝবে না। আপনি যদি রাজি না হন, সে আপনাকে অপমান করবে, গালি দেবে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবে, আপনি ঘুমিয়ে গেলে ঘুমন্ত অবস্থায় আপনার উপর চড়াও হবে।
আপনি যদি আপনার চাহিদার কথা বলেন, আপনাকে বেশ্যা বলে গালি দেবে, নোংরা কথা বলবে আপনার চরিত্র নিয়ে, এমনকী আপনাকে নিয়ে অন্যের কাছে টিটকিরি করার মত নীচতাও দেখাবে।

দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে, প্রেম ভালবাসাটাকে পর্ণ মুভি বানিয়ে ফেলা। সেক্স যে ভালবাসার চরমতম বহিঃপ্রকাশ, এই জিনিসটা আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী মানতে চায়না। আপনাদের সেক্স শুরু হয় পর্ণ মুভির মত, যেখানে আপনি অভিনেত্রী আর আপনার সংগী হচ্ছেন ডাইরেক্টর।আপনাকে কখন কিভাবে কি করতে হবে তা শতভাগ ঠিক করে দেবে আপনার সঙ্গী, তা আপনার ভাল লাগুক বা না লাগুক। সে সেক্সকে ভালবাসা নয়, আপনাকে ছোট করার একটা উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। ভালবাসাবাসির বদলে সেক্সের মাধ্যমে সে আপনার উপর তার দখলদারিত্ব ফুটিয়ে তোলে , শারীরিক শক্তিতে আপনি যে কত দুর্বল সেটা ইচ্ছে করে আপনাকে দেখায়। পুর ব্যাপারটা আপনার কাছে আনন্দময় না হয়ে ভীতিপ্রদ হয়ে দাঁড়ায়। আরও ভয়াবহ একটা কাজ সে করে, তা হচ্ছে আপনাদের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ছবি বা ভিডিও তুলে রাখা।আপনি তাকে ছেড়ে যাবার হুমকি দেয়ামাত্র সে ওই ছবি বা ভিডিওর সাহায্যে আপনাকে ব্ল্যাকমেইলের হুমকি দেয়( সাধারণত এটা বাংলাদেশে প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়। এছাড়া সম্পর্ক শেষ হবার পর অতীতের ছবি/ভিডিও নিয়ে নোংরামি করাটাও খুব কমন। ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে কি করবেন এটা নিয়েও লেখা আছে- আমার নোটস ঘাঁটলেই পাবেন)।

উপরের লক্ষণগুলোর সারমর্ম দাঁড় করালে এক লাইনে বলা যায়, “Sex is ALWAYS about HIM and HIS needs, NOT yours”

আপনাদের সম্পর্কে যদি সেক্সটাকে এভাবে দেখা হয়- আপনি কিন্তু নিপীড়িত হচ্ছেন!

#কেন_করে_এটা?

একজন নিপীড়ক মনের দিক দিয়ে প্রচন্ড কাপুরুষ প্রকৃতির হয়, এরা ভেতরে ভেতরে মারাত্মক রকমের ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। এই ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স ঢাকতে সে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আপনার উপর নিপীড়ণ চালিয়ে নিজেকে শক্তিশালী ভাবে। আপনাকে অপমান করার মাধ্যমে সে নিজের ভেতরে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পায়। এরা ইচ্ছে করে সেক্সকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে- সেক্স দেয়া এবং না দেয়ার মাধ্যমে আপনার পায়ের নীচের মাটি সরিয়ে দেয়। পঞ্চাশোর্ধ্ব এক এ্যাদভোকেট ভদ্রমহিলা তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে জানালেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়ে শুধু জৈবিক চাহিদা মেটাতে নিপীড়কের সাথে থেকে যায়, সংসার করে। এরা দুশ্চরিত্রা নয়, সঙ্গীকে ঠকিয়ে আরেকজনের কাছে যাওয়ার কথা এরা কল্পনাও করত এ পারেনা। একদিকে সততা, আরেকদিকে শারীরিক প্রয়োজন- এ দুটো মিলিয়ে এই অসহায় মেয়েগুলর যাওয়ার জায়গা একমাত্র ওই নিপীড়ক সঙ্গীটিই।

#কি_করবেন_এরকম_হলে?

আমাদের মধ্যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে খুব কম মানুষই সেক্স নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, বিশেষ করে সেক্সকে যদি নিয়ন্ত্রণ আর নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বিবাহিত জীবনে এটা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা মোটামুটি অকল্পনীয়। এছাড়া সামাজিক ব্যাপারগুল তো আছেই, আমরা মুখে নারী জাগরণের কথা বলি কিন্তু দিনের শেষে নারীকে বিচার করি তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য দিয়েই। “আদর্শ” নারীর যে সংজ্ঞা সমাজ আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে, ওটা একেবারে ফিনাইল দিয়ে ধুয়েমুছে ফেলুন- এটা হবে নিপীড়ণের হাত থেকে বাঁচার প্রথম পদক্ষেপ। “আদর্শ নারী” মানেই মাথা নীচু করে চলা, সব অন্যায় মেনে নিয়ে পাষণ্ড স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করা সতিসাধ্বী নারী নয়। একজন আদর্শ নারী হবেন ব্যক্তিত্ববান, তিনি নিজের মর্যাদা দিতে জানবেন, সেই সাথে জানবেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। এ সিরিজের সমাধান পর্বগুলোতে আমি বিস্তারিত আলচনা করব নিপীড়ণের শিকার হলে কি করতে হবে এটি নিয়ে। আপাতত; সেক্সুয়াল পাওয়ারপ্লে এবং এযাবিউজ সম্পর্কে তিনটি জিনিস মনে রাখুনঃ

১) প্রথমেই ঠান্ডা মাথায় ভাবুন এবং চিহ্নিত করুন আপনি যৌন নিপীড়নের শিকার কিনা। এই আর্টিকেলটি একটি বেসিক উপায় হতে পারে চিন্তার খোরাক হিসেবে।
২) খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করুন, দোষ আপনার নয়, আপনার নিপীড়কের। এই বিশ্বাসটা আনা ভীষণ রকমের জরুরী
৩) নীরবে লজ্জিত হতে অস্বীকার করুন। অন্ততঃ মনেমনে জানুন যে আপনি নিপীড়িত হলে লজ্জাটা আপনার নয়, নিপীড়কের। কতটা কাপুরুষ হলে ভালবাসার নামে সঙ্গী/সঙ্গিনীকে সেক্সের মত অনুপম স্বর্গীয় একটা বিষয় নিয়ে নিপীড়ণ করে একতা মানুষ- এটা ঘৃণাভরে অনুধাবন করুন।

যৌন নিয়ন্ত্রণ স্বাভাবিক কিছু নয়, এবং এরকম করা হলে “সব ঠিক” বলে মেনে নেয়াটাও মটেই ঠিক নয়।আপনাকে এটা মেনে নিতে হবেনা, আপনি আপনার পরিস্থিতি বদলাতে পারবেন না এ ধারণাও সঠিক নয়। আপনি আপনার নিপীড়ককে পাল্টাতে পারবেন না, ওটা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। বরং পাল্টাতে হবে আপনাকেই।

কিভাবে পাল্টাবেন?

সঙ্গে থাকুন, সমাধান আসছে

  • পঞ্চম পর্ব

Comments

comments