(জ্বলে উঠবনা কেন???)
( “জ্বলে উঠবনা কেন” একটি পার্বত্য অঞ্চলের কবিতা, খুব ছোটবেলায় বাবার চাকুরির সুবাদে এটি শুনেছিলাম।আজকের পর্বের শিরোনামটি কবিতার শিরোনামের সাথে মিলিয়ে দেয়া । আজকের পর্বে আমার ব্যক্তিগত বেশ কিছু দৃষ্টিভঙ্গি অসঙ্কোচে তুলে ধরেছি, সেই সাথে শেষের অংশটি লিখেছি ইন্টারনেটের বিভিন্ন ইংরেজি আর্টিকেল থেকে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভাবানুবাদ করে।পাঠক চাইলে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি অংশটুকু বাদ দিয়ে শেষের একাডেমিক অংশটুকু পড়তে পারেন)
নিপীড়ণের দুষ্টচক্রের প্রথম চারটি পর্বে নিপীড়নের ধরণ এবং কোন কোন ধাপে নিপীড়ন হয় তা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আজ থেকে আগামী কয়েকটি পর্ব থাকবে এর সমাধান নিয়ে। নিপীড়নের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি- সেটি কিন্তু আপনার হাতেই আছে। আপনি যেখানে, যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, আপনার সামাজিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিক অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন- এই অত্যাচার বন্ধ করার চাবিকাঠি আপনার নিজের হাতে।
এই চাবিকাঠিটা হচ্ছে শক্ত মনের জোর। আপনি সিদ্ধান্ত নিন যে দুনিয়া উলটে গেলেও এই অত্যাচার-অবিচার আপনি মেনে নেবেন না।তারপর এই সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে নিজের জীবনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনটুকু আনতে থাকুন।
কাজটা সহজ নয়, বেশ কঠিন।কিছুদিন একটা কুকুরের সাথে থাকলে তার উপরেও মায়া পড়ে যায়, আর আপনার নিপীড়ক তো মানুষ। যতবার আপনি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইবেন, অতীতের সুখস্মৃতিগুলো আপনাকে বাধা দেবে বারবার, অনিশ্চয়তা থেকে পিছু হটতে চাইবে আপনার মন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পোস্টমাস্টার গল্পের শেষে লিখেছেনঃ
“হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে”
#ব্যক্তিগত_কত্থোপকত্থন
প্রিয় পাঠক, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, উপরের লাইনগুলো মর্মান্তিকভাবে সত্যি।ছাত্রজীবনে আমি নিজে প্রায় আড়াই বছর একটি নিপীড়ণমূলক সম্পর্কের ভেতরে ছিলাম। অকাট্য, অভ্রান্ত সব প্রমাণ পেতাম আমার উপরে করা তার অত্যাচারগুলোর-কিন্তু তখন আমি এই সাইকেল অফ এ্যাবিউজ সম্পর্কে জানতাম না।
কত অসংখ্যবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর নয়, এবার লাত্থি মেরে বেরিয়ে আসব এই সম্পর্ক থেকে- কিন্তু পারিনি।বিশেষ করে ব্যাপারটা যদি প্রথম প্রেম হয়, এভাবে বেরিয়ে আসাটা অসম্ভবের কাছাকাছি।
এই বেরিয়ে আসতে না পারার ফলে এক সময় ভয়াবহ রকমের মূল্য আমাকে দিতে হয়েছে। যে সম্পর্কের জন্যে সারা পৃথিবী এক দিকে আর তাকে একদিকে রেখেছিলাম, সহ্য করেছিলাম সব রকমের অন্যায় আচরণ- সেই সম্পর্ক কিন্তু টেকেনি। পুলিশে ঢোকার শুরুর দিকেই সম্পর্কটি শেষ হয়ে যায়, তার পক্ষ থেকেই। আপনার সম্পর্ক যদি সত্যিকারের ভালবাসার বদলে নিপীড়ণের উপর ভিত্তি করে হয়, সে সম্পর্ক কোনদিনও টিকবে না। যত দ্রুত আপনি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতে পারবেন, ততই মঙ্গল।
এই নিপীড়কদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা প্রচন্ড রকমের প্রতিশোধপরায়ণ হয়। যদি কখনও এরা খবর পায় যে আপনি অন্য কারও সাথে সুখী হতে যাচ্ছেন- এই সংবাদ তাদের কাছে মৃত্যুর মত হবে। সে তখন আপনার প্রথম প্রেমের আবেগকে কাজে লাগিয়ে আপনার সাথে যোগাযোগ করবে, ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক আপনার নতুন পাওয়া সম্পর্ককে নষ্ট করতে চাইবে। এ সময়টায় এরা আপনার সাথে এত মধুর ব্যবহার করবে, আপনি ভুলেই যাবেন যে সে আপনাকে কি নির্লজ্জ্বভাবে অত্যাচার করেছিল। যে মুহূর্তে আপনি আপনার নতুন পাওয়া সম্পর্ককে তার ছলনায় ভুলে ভেঙে দেবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সে-ও উড়াল দেবে আপনার জীবন থেকে।
নিজের বোকামির জন্যে তখন আপনার চারপাশে থাকবে গাঢ় নীল হতাশা, যে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসা সমুদ্রমন্থনের চাইতেও কঠিন।
Remember, your ex is an ex because there is a reason. NEVER EVER think that he has changed because people NEVER do.
#একাডেমিক_আলোচনাঃ
ব্যক্তিগত কত্থোপকত্থন শেষে ফিরে আসি। হেলথ সেন্ট্রাল ডট কম ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ উপযোগী বলে মনে হয়েছে। আপনাদের সুবিধার্থে ভাবানুবাদ করছিঃ
কখন বুঝবেন আপনার এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে?
১) প্রতিটা মুহূর্তে আপনার পার্টনারকে আপনি প্রচন্ড ভয় পাওয়া শুরু করেছেন।
২) আপনার পার্টনারের কারণে বাধ্য হয়ে প্রতিনিয়ত এমন সব কাজ করছেন যা আপনি করতে চান না।
৩)নিজের পরিবার পরিজনের সাথে সময় কাটানোর ফলে আপনার ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করে, যেটার কোন ভিত্তি নেই। এই অপরাধবোধটাকে জাগিয়ে তোলে আপনার পার্টনার, যে আপনাকে বোঝাতে চায় সে ছাড়া আপনার পৃথিবীতে আর কিছু থাকতে পারবেনা।
৪)পান থেকে চুন খসলেই আপনার পার্টনার দুর্ব্যবহার করে- এই ভয়ে আপনি সিঁটিয়ে থাকেন সব সময়।
৫) আপনার কথাবার্তা, চাল-চলন, আত্মসম্মানে নাটকীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে আপনার কাছের মানুষেদের কাছে, এবং এই পরিবর্তন ভাল কিছু নয়- আপনার সত্তাটাই যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
৬) আপনার পার্টনারের জন্যে কোনকিছুই আপনি ঠিকভাবে করতে পারছেন না- এরকম মনে হচ্ছে সবসময়।
৭) এই মানুষটার সাথে থাকার পর আপনি উচ্ছ্বাসিত বোধ করার বদলে লজ্জা, দোষ এবং নিজেকে নিয়ে খারাপ অনুভব করেন।
৮) নিজের জন্যে আপনি কিছুই করছেন না, আপনার সমগ্র অস্তিত্বটাই যেন আপনার পার্টনারের জন্যে।
৯) নিজেকে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত মনে হয় আপনার, যে ফাঁদ থেকে কোন মুক্তি নেই
১০) নিজেকে আপনি অপমানিত, অসম্মানিত এবং তুচ্ছ ভাবেন- কারণ এভাবেই আপনার পার্টনার আপনাকে ব্যবহার করে।
#বটম_লাইনঃ
আপনার পার্টনার যদি এখন আপনাকে খারাপভাবে ট্রিট করে, সে এটা ভবিষ্যতেও করবে এবং মাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় তা শারীরিক নির্যাতনের দিকে যাবে।একজন নিপীড়ণকারী কখনোই “ভাল” হয়ে যায়না, সে কখনোই বদলায় না। মনে রাখবেন, সে আপনার প্রতি বিশ্বস্ত নয়, আপনার মাধ্যমে সে যেসব প্রয়োজন মেটায় সেগুলোর প্রতি বিশ্বস্ত। যে মুহূর্তে তার প্রয়োজন মেটাতে আপনি পারবেন না, ঠিক সে মুহূর্তে তার বিশ্বস্ত্বতাও আর থাকবেনা।
তাকে আপনি পাল্টাতে পারবেন না, পাল্টাতে হবে আপনার নিজেকেই।এই পাল্টানোর একটা ধাপ হচ্ছে লাত্থি মেরে তার সংসর্গ পরিত্যাগ করা। গত পাঁচ বছর সে আপনাকে নিপীড়ণ করেছে মানে এই নয় যে আগামী পাঁচ বছরও সে আপনাকে নিপীড়ণ করেই যাবে।
আজকের এই পুরো আর্টিকেল থেকে যদি একটা শিক্ষা আপনি নিতে চান, নীচের লাইনটি পড়ুনঃ
যেভাবে একদিন সর্বস্ব দিয়ে এই নিপীড়কের প্রতি আপনি বিশ্বস্ত ছিলেন, ঠিক একইভাবে আপনাকে এই সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রতি সর্বস্ব দিয়ে বিশ্বস্ত হতে হবে।
আপনি যদি ন্যূনতম দুর্বলতা দেখান, এতটুকু আবেগ যদি আপনার ভেতরে প্রকাশ পায়- প্রচন্ড ধূর্ত নিপীড়ক ঠিক সেই জায়গায় আঘাত হানবে এবং আপনাকে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনবে।
আমি বলছিনা কালকেই আপনি নিপীড়কের বাড়ি ত্যাগ করবেন। আপনার প্রথম কাজ হবে সিদ্ধান্ত নেয়া যে এই নিপীড়ণকে আপনি আর মেনে নেবেন নয়া- এনাফ ইজ এনাফ। তারপর সময় নিয়ে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস,এমনকী কয়েক বছর ধরে হলেও নিজেকে প্রস্তুত করুন।তারপর সময় ও সুযোগ বুঝে লাথি মারুন ওই পঁচে যাওয়া সম্পর্কে।কিভাবে লাত্থি মারবেন এবং বেছে বেছে কি কি প্রস্তুতি নেবেন-এ সম্পর্কে পরের পর্বে খুঁটিনাটি আলোচনা করব। শেষ করছি রবিঠাকুরের কবিতা দিয়েঃ
যখনি দাঁড়াবে তুমি তখনই তোমার সম্মুখে সে
পথ-কুক্কুরের মত সভয়ে, সত্রাসে যাবে মিশে।
নিপীড়কেরা পথ-কুক্কুরের চাইতেও অধম, এরা তেলাপোকাশ্রেনীর।সিদ্ধান্ত নিন আপনি মাথা তুলে দাঁড়াবেন, বাকি সবকিছু আপনা থেকেই হয়ে যাবে।শুধু সিদ্ধান্তটুকু নিয়েই দেখুন!