হার্ভার্ডের দিনলিপি ০০৭

ঝড়ের গতিতে দিন কেটে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস হয়ে গেল হার্ভার্ডে। এক একটা দিন কেটে যায় আর মনে মনে ভাবি- হায়, এভাবে একদিন আমার সময় ফুরিয়ে আসবে, বিদায়ের সানাই বাজবে- স্বপ্নের জগৎ ছেড়ে পাড়ি দিতে হবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে! এখানে রীতিমত স্বর্গে আছি- যে কাজটা করতে ভালবাসি সেটাই করছি প্রাণ ভরে- বই পড়ছি, সহপাঠী এবং প্রফেসরদের সাথে চিন্তার আনাগোনা করছি, ঋদ্ধ করছি নিজেকে যেভাবে যতটুকু পারি! জ্ঞানার্জনের এই মহাযজ্ঞ একদিন শেষ হয়ে যাবে- ভাবতেই কিরকম বিষাদ জাগে!

এখানে একটা জিনিস খুব ভালো লাগছে- মুখের উপর দ্বিমত করা যায়, কেউ কিচ্ছু মনে করেনা। সমালোচনা এখানে স্বাগতম, যদি সেটা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে হয়।সাইবার সিকিউরিটি ক্লাসে পলিসি মেমো লিখতে দিয়েছে- প্রফেসর রোজেনবার্গ জানালেন, আন্তর্জাতিক ছাত্ররা চাইলে তাদের দেশের বসের কাছে এরকম মেমো লিখতে পারবে এবং সেই মেমোতে আমেরিকার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলেও উনার আপত্তি নেই। এই ক্লাসে চায়না সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য আলোচনা করা হল। চায়নার গ্রেট ওয়ালের কথা তো আমরা সবাই জানি, সাইবার জগতে চায়নার আরেকটা জিনিস আছে- গ্রেট ফায়ারওয়াল। গ্রেট ফায়ারওয়াল হল চায়নিজ সরকারের আরোপিত টেকনোলজি এবং আইনি পলিসির একটা সামগ্রিক রূপ যেটা এক বিলিয়নেরও বেশি চায়নিজ নাগরিকের ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর নানারকম সেন্সরশিপ আরোপ করে। এই জিনিস যখন তৈরি হচ্ছিল রোজেনবার্গ তখন পেন্টাগনের কর্মকর্তা। এরকম একটা জিনিস হচ্ছে শুনে উনি হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন, এক বিলিয়নের বেশি মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহার কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এইটা উনার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। নিজের এই ব্যর্থতা সবার সামনে তিনি স্বীকার করে নিলেন- জানালেন, চায়নিজরা যে এটা করে ফেলবে এইটা তিনি কল্পনা করেন নি। চায়না, আমেরিকা এবং ইউরোপের কয়েকটা দেশের সাইবার সিকিউরিটি পলিসি আমাদেরকে প্রি-ক্লাস রিডিং হিসেবে পড়তে দেয়া হয়েছিল। এই দেশগুলো সাইবার সিকিউরিটিকে কি ভয়াবহ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে এটা দেখলাম, বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চায়নিজ পলিসিতে তো সরাসরি লেখা- “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আর সাইবার নিরাপত্তার ভেতরে কোনও পার্থক্য নেই।উন্নতির মূল সোপান হচ্ছে নিরাপত্তা, নিরাপত্তা নেই তো উন্নতিও নেই”। এই ক্লাসের ফাইনাল এ্যাসাইনমেন্ট হচ্ছে নিজ দেশের জন্য সাইবার নিরাপত্তা পলিসি রচনা করা। ঠিক করেছি এই কাজটা আমি সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে করব এবং এই পলিসি বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দেবো। তাঁরা ওটা কতটা সিরিয়াসলি নেবেন এটা আমি জানিনা, বা আমার পলিসি পেপারটা যে খুব ভালো হবে এটার বিবেচনাও আমার হাতে নেই। একটা জিনিস অবশ্য আমার হাতে আছে- চেষ্টা। রবিঠাকুরের চার লাইনের কবিতা মনে আছে কারো?

“কে লহিবে মোর কার্য?- কহে সন্ধ্যারবি
সমগ্র জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, “স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য, করিব তা আমি”

আজ এই ক্লাস শেষ করে প্রফেসরের সাথে কয়েকটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছি, এর মাঝে পেছন থেকে পরিষ্কার বাংলায় কে জানি বলল- “ ভাই তুমি বাংলাদেশের কোথাকার? আমি বাংলাদেশ ভালবাসি”। পিছন ফিরে দেখি সাড়ে ছয় ফুট লম্বা এক দুর্ধর্ষ হ্যান্ডসাম শ্বেতাঙ্গ ছেলে।পুরোমাত্রায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, সেই ছেলে বলে- আরে ভাই আমি ডেকেছি তোমাকে।

আমার মুখ দিয়ে তখনও ইংরেজি বেরুচ্ছে- মানে মস্তিষ্ক দেখলেও চোখ দেখতে চাইছে না।ছেলেটা হেসে বলল, আরে ভাই, আমার বাবা ইউএন ডিপ্লোম্যাট ছিলেন, আমি বড় হয়েছি বাংলাদেশে। তোমাদের আওয়ামী লীগ-বিএনপি ক্যাচাল আমি জানি, কাচ্চি বিরিয়ানি হইলো আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

ফট করে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল- “বিয়েশাদী করছ নাকি মিয়া? না করলে তোমারে বাংলাদেশে নিয়ে একটা বিয়ে করায়ে দিব। যেমন সুরত বানাইছো, দেশে নিয়ে গেলে আমার মেয়ে কাজিনগুলা পাগল হয়ে যাবে।“
হেসে দিয়ে বলে, ভাই, কাচ্চি খাইতে পারলে তোমার এই প্রস্তাবে আমার কোনই আপত্তি নাই। জিজ্ঞাসা করলাম, পড়াশোনা কতদূর করছ? বলল, বাংলাদেশে পড়তাম আমেরিকান স্কুলে। এরপর নিউরোসায়েন্সে পড়াশোনা করেছি, এখন হার্ভার্ড আর ডার্টমাউথে (এইটা আরেকটা আইভি লীগ স্কুল, গডফাদারের মাইকেল কর্লিয়নি এইখানে পড়াশোনা করেছে) জয়েন্ট ডিগ্রি করছি- তিন বছরে দুটো মাস্টার্স একসাথে।
বললাম, আইস-সালা! তুমি তো মামা একখান “জিনিস”! নাহ, তোমার ব্যবস্থা করতেসি।

ছেলেটার নাম সিমোন। ক্লাস শেষে ছিল হ্যাপি আওয়ার, এর মানে প্রফেসর এখন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাইরে ‘শেলবি’ নামের একটা বারে খানাপিনা করবেন, “দুষ্ট পানি” খাবেন। সিমোনকে ওইদিকে এগিয়ে দিলাম- যা বেটা দুষ্ট পানি খা গিয়ে!

পুলিশিং ইন গ্লোবাল কনটেক্সট ক্লাসে একটা দারুণ জিনিস জানলাম।সাইকোলজি ফিল্ডে এই মুহূর্তে একটা বিশাল রেভোলিউশন চলছে- কেউ কেউ এটাকে বলছে ফান্ডামেন্টাল ক্রাইসিস। বিখ্যাত যেসব এক্সপেরিমেন্টের উপর এই ডিসিপ্লিনটা দাঁড়িয়ে আছে, এসব এক্সপেরিমেন্টগুলোর অনেকগুলোই অন্য জায়গায় রেপ্লিকেশন করা যাচ্ছেনা।

এ্যাকাডেমিয়াতে গবেষকরা ভীষণভাবে নির্ভর করেন পিয়ার রিভিউড একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলের উপর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হতে হয় একাডেমিক জার্নালে, সেই জার্নালে এই আর্টিকেলগুলো পড়ে জ্ঞানলাভ করে নতুন গবেষক, সেই জ্ঞানের সাথে নিজের বুদ্ধিমত্তা মিলিয়ে সৃষ্ট হয় নতুন জ্ঞান।

একটা ভালো জার্নালে একাডেমিক পেপার পাবলিশ করা মোটামুটি একটা যুদ্ধজয়ের মত কঠিন কাজ। নানাজন নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা পেপার ( পেপার মানে হচ্ছে আপনার গবেষণার ফল সুনির্দিষ্ট রীতিনীতি মেনে যেভাবে আপনি প্রকাশ করবেন) পাবলিশের অনুমতি দেয়। এইটা ফেসবুক পোস্ট না বা দিনলিপি না যে ইচ্ছে হল আর ছেড়ে দিলাম, বছরের পর বছরও লেগে যায় পেপার “এ্যাকসেপ্টেড” হতে।
সাইকোলজির যে এক্সপেরিমেন্টগুলো, এগুলোর একটা বিশাল সমস্যা দেখা গিয়েছে সর্বজনীনতা নিয়ে। মানে, এই ফিল্ডের খুব বিখ্যাত যেসব এক্সপেরিমেন্ট গত বিশ ত্রিশ বছর ধরে গবেষকরা সর্বজনীন ধরে নিয়ে তার উপর ভিত্তি করে নতুন গবেষণা করেছেন, তার অনেক গুলোই দেখা যাচ্ছে সর্বজনীন না! একটা এক্সপেরিমেন্ট সর্বজনীন হতে হলে তাকে আফ্রিকা আর আমেরিকাতে একই ফল দিতে হবে, স্থান বা সময়ের ব্যবধান এতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারবেনা। এই বিশ ত্রিশ বছর আগে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এক্সপেরিমেন্ট রিপ্রোডিউস করতে গিয়ে তা একে একে ধরা খাচ্ছে!

ক্লাসিকাল ফিজিক্স দাঁড়িয়ে আছে নিউটনের গবেষণার উপর। এখন যদি আপনি দেখেন নিউটনের সূত্রগুলো ক্লাসিকাল ক্ষেত্রে সর্বজনীন না, সেক্ষেত্রে পুরো ফিজিক্স ডিসিপ্লিনটাই নতুন করে লিখতে হবে।

প্রফেসর এ্যাবট বললেন, সাইকোলজি এখন এই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এবং এটা ধরে নেবার কোনই কারণ নেই যে এই ক্রাইসিস জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় সংক্রামিত হবে না!

পরের দিন সকালে বাস স্ট্যান্ডে দেখা হল সজীব ভাইয়ের সাথে। ইনি সেই সজীব ভাই যিনি এমআইটিতে গবেষণা করেন এবং আমার জন্য বোস্টনের একটি খুব দুষ্ট নামওয়ালা জায়গায় (হুকার স্ট্রীট) বাসা ভাড়া করে দিয়েছেন। হুকার স্ট্রীট নামটা এসেছে আমেরিকান জেনারেল হুকারের নাম থেকে- কিন্তু ফাজিল আমেরিকান জাতি দুইশ বছরের মধ্যে এই নামটার অর্থ করে নিয়েছে যৌনকর্মী। কি বেইজ্জতি ব্যাপার, ভার্সিটির বন্ধুবান্ধবেরা শুনলে মুখ টিপে হাসে, মুরুব্বীদের কাছে কই থাকি বলতে পারিনা! এই সজীব ভাইও জানালেন, উনার ফিল্ডে ( ক্যান্সার গবেষণা) একই কাহিনী চলছে গত দশ বছর ধরে। এক গবেষণার ফল আরেক ল্যাবে নিয়ে রেপ্লিকেট করা যাচ্ছেনা!
কেমব্রিজ তথা বোস্টন হচ্ছে আমেরিকার জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষনার প্রাণকেন্দ্র। এখানে থাকার সুবিধা হচ্ছে, চোখ কান খোলা রাখলে আপনি অনুভব করতে পারবেন বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞান কোন দিকে যাচ্ছে। এটার অনুভূতি আসলে লিখে বোঝানো যাবেনা।

আমার দিনলিপি লেখার একটা অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের ছেলেমেয়েদের মাথা থেকে এখানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (হার্ভার্ড/এমআইটি ইত্যাদি) নিয়ে যে “মিথ” আছে এটা ভেঙে দিয়ে এগুলোকে তাদের “হাতের নাগালে” এরকম ভাবনা সৃষ্টি করা। ভারত, নেপাল এমনকি পাকিস্তানের ছেলেমেয়েতে হার্ভার্ড ক্যাম্পাস ভরা অথচ বাংলাদেশিরা হাতে গোনা। দুই হাজার আঠারো সালে এসে এই জিনিস মেনে নেয়া যায়না। টাইম ফর আস টু রাইজ! শুধু ক্রিকেটে না, রাইজ করতে হবে জ্ঞান বিজ্ঞানে, মননশীলতার চর্চায়। এটা যদি করতে না পারি আমরা, আগামী দুইশ বছরও ওদের পায়ের তলে থাকা লাগবে আমাদের।

শেষ করি আমেরিকার আরেকটা দিক বলে। গোটা হার্ভার্ড ক্যাম্পাস তোলপাড় গত কয়েকদিন ধরে, বিশেষ করে প্রচণ্ড ক্ষেপেছে মেয়েরা। কি ব্যাপার? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন একজন বিচারপতি নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন( ভদ্রলোকের নাম কাভানা), যে ভদ্রলোক যৌবনে একজন নারীকে যৌন নির্যাতন করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ভদ্রমহিলা একজন প্রফেসর এবং দুই সন্তানের জননী। তিনি সেদিন সাক্ষী দিয়েছেন সিনেট কমিটির সামনে।

তবে আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কিছুতেই কিছু হবেনা। এরকম একজন মানুষ বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের বিচারপতিদের একজন হয়ে যাবে, তারপর তার ইশারায় নির্ধারিত হবে অগণিত মানুষের ভাগ্য। খোদ আমেরিকায়।

এই প্রথম মনে হল, বাংলাদেশকে আমরা যতটা ইম্পারফেক্ট ভাবি ততটা ইম্পারফেক্ট সম্ভবত আমরা না। খোদ আমেরিকার এই অবস্থা, সেই তুলনায় একটা নবীন দেশ আর কদ্দুর কি করবে?

জানি, আমার এই চিন্তাধারা আবেগপ্রসুত। আই এ্যাম এন ইমোশনাল ফুল, আস্ত একটা আবেগপ্রবণ গাধা।

মুশকিল হচ্ছে, গাধা থেকে মানুষ হবার কোনও লক্ষণ অদূর ভবিষ্যতে দেখছি না!

#হার্ভার্ড

Comments

comments