আজ সকালের রিডিং কোর্সে খুব কাজের কিছু জিনিস শিখিয়েছে। এই কোর্সের উদ্দেশ্য হচ্ছে কিভাবে স্ট্রাটেজিকভাবে পড়তে হয় এটা শেখানো। নন-ক্রেডিট, পাঁচ দিনের কোর্স- প্রফেসর অরোরা একজন মেক্সিকান আমেরিকান ভদ্রমহিলা। কোর্সটি ডিজাইন করা হয়েছে আমাদের মত নন-আমেরিকান ছাত্রছাত্রীদের জন্য। আজ একটু বিস্তারিত লিখব কারণ মনে হচ্ছে এই বিষয়গুলো সবার কাজে লাগবে, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের।
ক্রোভিজ ছিলেন স্মৃতিভ্রংশের উপর অনেক বড় গবেষক। স্মৃতিভ্রংশ নিয়ে গবেষণা করার একটা বড় বিপদ হচ্ছে- এর কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন নেই-প্রতিটা কেসই নতুন কেন( এই আর্টিকেল বেশ আগে লেখা, এখন হয়ত গবেষণা বহুদূর এগিয়েছে)। রিকি নামে এক মেয়েকে নিয়ে ক্রোভিজ গবেষণা করেছেন- একটা দুর্ঘটনায় সে তার গত এক বছরের স্মৃতি সব হারিয়ে ফেলেছে। ক্রোভিজ দেখতে চাইলেন এই স্মৃতি হারানোতে তার সবচাইতে বড় ক্ষতি কি হয়েছে। জানা গেল, গত বছর ও প্রেমে পড়েছিল এবং প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। অথচ দুর্ঘটনার পর ওর পুরো স্মৃতি উধাও! হতভাগ্য প্রেমিক পুরো বিপর্যস্ত!
বহু চেষ্টা করে রিকির স্মৃতি ফিরিয়ে আনা যায়নি, তবে ক্রোভিজ দেখলেন- এই স্মৃতি হারানোর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে রিকির মানসিক অবস্থার। একজনের স্মৃতি তার অস্তিত্বের অংশ-এটার কিছু অংশ হারিয়ে ফেলার মানে হচ্ছে নিজের অস্তিত্বকেই হারিয়ে ফেলা। এ থেকে যে বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয় তা ভয়াবহ!
যেহেতু একেক জন রোগীর ধরণ একেক রকম, কিছুতেই ক্রোভিজ কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না কি করা যায়। শেসে বিরক্ত হয়ে বললেন, যদি এক ক্লাস ভর্তি আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র পেতাম যাদের মাথায় একই শক্তিতে লাঠির বাড়ি দিয়ে স্মৃতি হারিয়ে তারপর গবেষণা করতে পারতাম!
অত ভয়ঙ্কর কিছু করতে হয়নি, ক্রোভিজ সহজ একটা উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন। আর্টিকেলের লেখককে( ভদ্রলোকের নাম এ্যাবিগেইল লিপসন) তিনি তিনটা শব্দ মনে রাখতে বলেন, তারপর একটা সংখ্যা দিয়ে তা থেকে সাত মনে মনে বিয়োগ করতে বলেন। এভাবে একটা দুটো তিনটা শব্দ এবং সাথে সাথে অঙ্ক করতে দেবার এক পর্যায়ে দেখা গেল সাবজেক্ট শব্দ মনে রাখতে পারছেনা বা পারলে গুলিয়ে ফেলছে!
এই কৃত্রিম স্মৃতিভংশ ব্যবচ্ছেদ করে ক্রোভিজ একটা রেসিপি পেলেন যা যে কোন কিছু ভুলে যেতে সহায়তা করে।
এই রেসিপির প্রথিম মশল্লা হল কোনওপ্রকার ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই তোতাপাখির মত কিছু মুখস্ত করতে যাওয়া। দ্বিতীয় মশল্লা হচ্ছে যে জিনিস মনে রাখতে হবে সেটার সাথে ভালভাবে পরিচিত না হওয়া।তৃতীয় মসল্লা হচ্ছে মাত্র একবার দেখা আর চতুর্থ মশল্লা হচ্ছে মনে রাখার জিনিস দেখার পর পরই অন্য কোনও বিষয়ে চলে যাওয়া।
ধরা যাক আপনি ভোকাবুলারি মুখস্ত করতে চান। ভুলে যাবার শিওর শট উপায়গুলো হচ্ছে- ১) লিস্ট ধরে এ টু জেড মুখস্ত করতে চেষ্টা করা ২) শব্দগুলো কি, কেন লাগবে, কিভাবে ব্যবহার হয় এইগুলো না জানা ৩) বইয়ে স্রেফ একবার দেখা, নিজে নিজে খাতায় লিখে বাক্য গঠন প্রাকটিস না করা আর ৪) ওয়ার্ড লিস্ট একবার দেখেই সাথে সাথে ফেসবুকে সেফাতুল্লার ওয়াজ দেখা শুরু করা।
আমি হিসাব করে দেখলাম, পাঠ্যবই এতদিন যা পড়েছি তার বেশিরভাগই এভাবে পড়ে এসেছি এতদিন- স্রেফ পাস করার জন্য বা ডিগ্রি নেবার জন্য। এই জিনিসগুলো জানতাম না দেখে ডিগ্রি হয়তো পেয়েছি, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারিনাই। জাপানে বা বাংলাদেশে একাডেমিক পড়াশোনা যা করেছিলাম সব গুলে খেয়ে বসে আছি!
অথচ মনে আছে সব গল্পের বইয়ের জটিল সব চরিত্র, বিচিত্র সব কাহিনী! কারণ, গল্পের বই পরার সময় গল্পটা মাথায় সাজাতাম, অন্য বইপড়ুয়ার সাথে আলোচনা করতাম, চিন্তা করে অনুমান করার চেষ্টা করতাম গল্পটা কোন দিকে যাচ্ছে। আফসোস, একই টেকনিক পাঠ্যবইয়ে খাটালা আজ কতদূর যেতাম!
এখানে এই জিনিসগুলো অনার্স প্রথম সেমিস্টারের ছেলেপুলে শেখে।মনে হল হায় রে, জীবনের ষোল আনাই মিছে!
আগের ক্লাসে প্রফেসর মার্শাল গানজের কথা বলেছিলাম। উনি পড়ান “পাবলিক ন্যারেটিভ-আমি, আমরা এবং এখন” নামের একটা কোর্স। বাড়াক ওবামার ইলেকশন ক্যাম্পেইনের যে মূল পাবলিক ন্যারেটিভ, “চেঞ্জ উই ক্যান বিলিভ ইন”- এটা এই মার্শাল গানজের অন্যতম কীর্তি। হার্ভার্ডে পরার সময় কৃষ্ণাঙ্গদের সম অধিকারের পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে ইহুদী এই ভদ্রলোক ক্লাস মিস দিচ্ছিলেন। ক্লাসে না আসলে ছাত্রত্ব বাতিল হবে এরকম চিঠি পেয়ে তিনি হার্ভার্ডকে বলেছিলেন(গল্পটা আবারও বলছি)- “How can I come back and study history at Harvard when I am busy making it?”
বিশ বছর পর গ্রাজুয়েশন শেষ করা এই মার্শাল গানজ এখন এখানের প্রফেসর। তিনি শেখান, কিভাবে একটা ন্যায্য দাবীকে আন্দোলনে পরিণত করতে হয়, কিভাবে সেটাকে এমন একটা গল্পের রূপ দেয়া যায় যাতে তা সমাজের সবাইকে নাড়া দেয়।
ক্লাসে উদাহরণ হিসেবে তিনি মার্টিন লুথার কিং এর বিখ্যাত বক্তৃতা “আই হ্যাভ এ ড্রিম” ভিডিওতে দেখালেন।
দেখানোর পর জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে উনি বার বার বলছেন, আমাদের এই মুহূর্তে মুক্তি প্রয়োজন কালো মানুষদের জন্য- যেভাবে উনি একটা আন্দোলনকে সফল করে তুলেছেন- এই বক্তৃতা সম্পর্কে তোমাদের মতামত কি?
একজন ছাত্রী বলল, এই বক্তৃতায় মেয়েদের কথা উঠে আসেনাই, শুধু বাচ্চা মেয়েদের কথা এসেছে। সেই সময়ে নারীদের অবস্থা নিয়ে যে মার্টিনও ভাবেন নি এই বক্তৃতা এর প্রমাণ।
অনেকেই অনেক কথা বলল- শুনলাম। হঠাৎ কি হল জানিনা, দু হাত তুলে চেঁচিয়ে বললাম, প্রফেসর, আমাকে ফ্লোর দাও- আমার জরুরি একটা ইনপুট আছে। ক্লাসের সবাই একটু অবাক হল, প্রফেসর হেসে দিলেন। বললেন, আর তো অল্প সময় আছে- আচ্ছা বলো কি বলবে।
আমি বললাম, প্রফেসর, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি- আমার মাতৃভাষা বাংলা। মার্টিন লুথার কিং এর এই স্পিচ আমি পড়লেও পুরোটা আগে দেখিনি। তবে এই ভাষাটা এবং আবেগটা সম্পর্কে আমি পরিচিত। কিভাবে জানো? আমাদের ফাদার অফ দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক একইভাবে হুবহু একই সুরে বলেছিলেন এরকম কথা।
প্রথমে বাংলায় বললাম- “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম!” এরপর ইংরেজিতে বললাম, He said, “Now is the struggle for our freedom, now is the struggle for our independence!”
পুরো ক্লাসরুম প্রথমে নিস্তব্ধ, তারপর সম্মিলিত হাততালি। কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রী মিস ডেভিস বলল, মাসরুফ, এই স্পিচটা আমাকে ইমেইল করো তো, আমি দুটার তুলনামূলক আলোচনা করতে চাই। প্রফেসর বললেন, আজকের ক্লাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনপুট তোমার কাছ থেকে পেলাম। মুক্তির দাবীর পেছনে যে আবেগ, এটা সারা পৃথিবীতে এক বলেই জানতাম, তোমার কোথায় আবার তা প্রমাণিত হল। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
কিচ্ছু মাথায় ঢুকছিলোনা- দুচোখ ভর্তি জল।
তুচ্ছ, নামহীন মানুষ আমি- দেশমাতৃকার জন্য কিচ্ছুটি করতে পারিনি এই জীবনে। কিন্তু এই নামহীন আমি হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার ২০০ অডিটোরিয়ামে পঞ্চাশটা দেশের ছাত্রছাত্রীর সামনে বঙ্গবন্ধুর বজ্রহুঙ্কার শুনিয়ে এসেছি মাতৃভাষা বাংলায়- এই গৌরবটুকু এক স্রষ্টা ছাড়া স্বয়ং মৃত্যুও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা!
জয় বাংলা!