পুলিশিং ইন গ্লোবাল কনটেক্সট ক্লাসে গেস্ট স্পিকার হিসেবে গতকাল এসেছিলেন কেমব্রিজ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পুলিশ কমিশনার ডক্টর ব্রানভিল বার্ড জুনিয়র। এই ক্লাসে মাত্র সাতজন ছাত্রছাত্রী- আমি বাংলাদেশের পুলিশ অফিসার, ব্রায়ান নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ বিভাগের অফিসার, রস জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ত্রিশ বছরের ভেটেরান, সাক্ষী মুম্বাই পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, ডরিন সাবেক কানাডিয়ান এম্বাসাডর, মারিসা টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন ব্রাজিলিয়ান ছাত্রী এবং সারাহ হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল আর স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলের জয়েন্ট ডিগ্রিপ্রার্থী।সাতজনের ক্লাসের জন্য দুজন প্রফেসর- প্রফেসর উইনশিপ এবং প্রফেসর এ্যাবট। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রথম নাম ধরে ডাকি, ঘরের খবর রাখি।
কমিশনার বার্ড এক ঘণ্টা দারুণ লেকচার দিলেন। পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পিএইচি করেছেন, ঝুলিতে দুটো মাস্টার্স আছে। সেই সাথে আছে পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা।কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান, একটু মোটাসোটা গোলগাল। মুখে হাসি লেগেই আছে।প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল, হাত তুললাম। বললাম, “কমিশনার, গতকাল বাংলাদেশের জন্য একটা ঐতিহাসিক দিন- দেশটির সাতচল্লিশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী মেজর জেনারেল হয়েছেন- জেনারেল গীতি (এটুকু শুনে তাঁর উদ্দেশ্যে ক্লাসে করতালি পড়ল। গীতি আন্টির ছেলে তমাল আমার ক্যাডেট কলেজের ছোটভাই- ওর কাছেই খবরটা শুনি।এরকম গুণী একজন মানুষের জন্য আর কিছু করতে পারিনাই, উনার নামটা সবার সামনে বলেছি এইটাই আমার সান্ত্বনা)। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে আর্মি/পুলিশ এসব জায়গায় নারীদের নিয়োগের সময় একটা অভিযোগ তোলে অনেকে- মেয়েরা তো ফিজিক্যালি ছেলেদের মত শক্তিশালী না, তারা কিভাবে পারবে এই সার্ভিস দিতে?”
যে উত্তরটি কমিশনার বার্ড দিলেন, এইটা আমাদের দেশের নারীবিদ্বেষী মূর্খদের মগজে গেঁথে দিতে পারলে কিছুটা শান্তি পেতাম। প্রায় পনের মিনিট ধরে তিনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন, যার সারাংশ নীচে তুলে দিচ্ছিঃ
এক) ফিজিক্যাল ফিটনেস বিষয়টা এমন না যে সব ছেলেরাই ফিজিক্যালি শক্তিশালী আর সব মেয়েরাই ফিজিক্যালি দুর্বল। মানুষে মানুষে হাজারটা পার্থক্য থাকে, একটা ছোটখাট এবং জীবনেও ব্যায়াম না করা ছেলের চাইতে ছোটবেলা থেকে খেলাধুলা করে আসা দীর্ঘদেহী একটা মেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। পুলিশ বা মিলিটারিতে ফিজিক্যাল ফিটনেসের যে স্ট্যান্ডার্ড- দেখা যায় ফিজিক্যালি শক্তিশালী বহু মেয়ে এইটাতে অনেক পুরুষ প্রার্থীর চাইতে ভাল করছে।
দুই) ফিজিক্যাল ফিটনেস এবং স্ট্রেংথ পুলিশ বা সেনাবাহিনী পেশার হাজারটা দিকের মধ্যে অতি জরুরী একটা দিক, কিন্তু এটা একমাত্র দিক না। একজন দক্ষ অফিসারকে নানা বিষয়ে দক্ষ হতে হয়, তাকে আইন জানতে হয়, যুদ্ধবিদ্যা জানতে হয়- অস্ত্র চালানো জানতে হয়, আর সবচাইতে বড় কথা- কমন সেন্স থাকতে হয়। একটা মেয়ের যদি এভারেজে ফিজিক্যাল ফিটনেস কিছুটা কমও থাকে, সেই ঘাটতি সে সহজেই বাকি গুনগুলো দিয়ে পুষিয়ে দিতে পারে। আভ্যন্তরীন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছেলে অফিসারদের চাইতে মেয়ে অফিসাররা আহত কম হয়। এর কারণ এইটা না যে তারা বিপজ্জনক কাজগুলো ছেলেদের চাইতে কম করে, এর কারণ হচ্ছে মেয়েরা অনেক বেশি সাবধানী হয়- তারা ছেলেদের চাইতে প্রসিডিউর অনুসরণ করতে বেশি আগ্রহী। বিশালদেহী এবং তথাকথিত পৌরুষদীপ্ত একটা ছেলে অফিসার যখন সেফটি প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে কাউবয়ের মত খালি হাতে এগিয়ে গিয়ে গুলি খায়, মেয়েটা তখন সতর্কভাবে প্রটোকল অনুসরণ করে, ব্যাক আপ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। পঁচিশ বছর চাকুরী করার পর কমিশনার পদে এসে বার্ড সাহেবের যে ফিজিক্যাল ফিটনেস এইটা দিয়ে তো উনি পুলিশে চাকুরীই পাইতেন না এখন পরীক্ষা দিতে হলে, এর মানে কি তিনি পুলিশ নন?
তিন) ট্রেডিশনালি যেসব ভূমিকা মেয়েদের বলে আমরা ধারণা করি- পুলিশ বিভাগে কিংবা বিভিন্ন ট্যাকটিকাল ইউনিটে সেই ভূমিকাগুলো অত্যন্ত জরুরী হলেও এখনও পর্যন্ত মেয়েদেরকে যথাযথভাবে সেসব জায়গায় নিয়োগ দেয়া হয়নি। যেমন, অস্ত্রধারী এবং উত্তেজিত কোনও ক্রিমিনালকে গুলি করে মেরে ফেলার চাইতে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠাণ্ডা করে গ্রেফতার করাটা অনেক বেশি জরুরী। ওই বিশালদেহী ছেলে পুলিশ যখন বীরদর্পে গুলি চালাবে, দেখা যাবে মেয়ে পার্টনার অফিসারটি কথা বলে তাকে শান্ত করছে। ব্রিটেনে এ কারণে প্রায়ই দেখা যায় একজন ছেলে অফিসার আর মেয়ে অফিসার জুটি বেঁধে কাজ করে।
সেনাবাহিনীর ইন্টারোগেশন এর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ভয়াবহ জঙ্গিকে সারাদিন পিটিয়ে কিচ্ছু করা যায়নি, অথচ একজন লেডি ইন্টারোগেটর ভুলিয়ে ভালিয়ে ঠিকই সব তথ্য আধাঘণ্টার মধ্যে আদায় করে নিয়েছে- এরকম রেকর্ড বহু আছে।
কাজেই, সেনাবাহিনী বা পুলিশে মেয়েরা কাজ করতে পারবেনা বলে যাদের ধারণা এবং এইটা প্রতিষ্ঠা করতে যারা বায়োলজির অজুহাত দেয় এই চিড়িয়াগুলো পুলিশিং বা মিলিটারি প্রফেশনের কিচ্ছু জানেনা। এরা এই দুহাজার আঠারো সালেও পড়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে- এই জাতীয় মানুষের সংখ্যা যত বেশি, সেই সমাজ তত পশ্চাদপদ। মেয়েরা জাগছে, সমাজ ধর্ম বায়োলজির অপব্যাখ্যা দিয়ে তাদেরকে দমিয়ে রাখার দিন শেষ বহু আগেই!
পুলিশিং ক্লাসের পরের দিন ছিল সাইবার সিকিউরিটি ক্লাস- প্রফেসর রোজেনবার্গের। ওবামা প্রশাসনের পেন্টাগনের চিফ অফ স্টাফ এই ভদ্রলোকের মস্তিষ্ক ক্ষুরের মত ধারালো, তবে উনাকে পছন্দ করি আরেকটা কারণে, নিজেকে তিনি “মিটহেড” রোজেনবার্গ বা হাবলু রোজেনবার্গ হিসেবে পরিচয় দেন। কট্টর টেকনিকাল বিষয়গুলোও ক্লাসে বলতে গেলে উনার সামনে সেগুলোকে একেবারে নন-টেকনিকাল হাবলু ভাষায় বলতে হয় যাতে সবাই বুঝতে পারে। এই ক্লাসে সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী আছে, এমআইটির কম্পিউটার গীক আছে, আইনজীবী আছে, ফিলসফির মেজরও আছে- কিন্তু কি অপূর্ব দক্ষতায় রোজেনবার্গ সবাইকে একই পর্যায়ে নামিয়ে এনে সাইবার সিকিউরিটির মত একটা কট্টর টেকনিকাল বিষয়কে সবার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন- এইটা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়না।
এসাইনমেন্ট হিসেবে সবাইকে একটা মেমো লিখতে দিয়েছিলেন। তিনটা সিচুয়েশন, যে কোনও একটা পছন্দ করে মেমো লিখতে হবে। সিচুয়েশনটা এরকমঃ চায়না আর আমেরিকার ভেতরে গত জানুয়ারি মাস থেকে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে। ট্রাম্প চায়নার পণ্যের উপর ট্যারিফ বসাচ্ছে, প্রতিবাদে চায়না বসাচ্ছে আমেরিকার উপর। মেমোর অপশনগুলো এরকমঃ
এক) আমি ট্রাম্প প্রশাসনের সিনিয়র সাইবার সিকিউরিটি উপদেষ্টা। ক্যাপিটলে ইন্টেল রিপোর্ট এসেছে যে চাইনিজ হ্যাকাররা ইতোমধ্যে আমেরিকার বেশ কিছু বাণিজ্যিক সাইট হ্যাক করে বড় ধরণের ক্ষতি করেছে। ট্রাম্প প্রচণ্ড খেপে গিয়েছে, বলেছে যে এই চায়নার তথাকথিত গ্রেট ফায়ারওয়াল ( যেটা দিয়ে চায়না বাকি বিশ্ব থেকে আলাদা থাকে ইন্টারনেট জগতে) আর গ্রেট ক্যানন ( যেটা দিয়ে চায়না বিশাল সব ডিডিওএস এ্যাটাক চালায়) এই দুইটারই বারোটা বাজাতে হবে। আমার কাজ হচ্ছে এমন একটা পলিসি মেমো বানানো
যেখানে ট্রাম্পের এই নির্দেশ পালনে সবচেয়ে ভাল কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয় সেটার ধারণা দেয়া।
দুই) আমি চাইনিজ জেনারেল জিয়াং এর অধীনে একজন কর্নেল। আমেরিকাতে যে সাইবার আক্রমণ হয়েছে এটা চায়নিজ হ্যাকাররা করলেও সরকারী আদেশে করেনাই, হ্যাকার গ্রুপ নিজেরা নিজেরাই করেছে। কিন্তু চায়নিজ এ্যাম্বাসাডর জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত এবং চায়নার উপর সাইবার আক্রমণ করতে তারা বদ্ধপরিকর। মহান চায়নিজ নেতৃত্ব মনে করে, আমেরিকাকে একটা শিক্ষা দেয়াটা জরুরী হয়ে পড়েছে। সামনে আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন, এইটাকে কাজে লাগানোটাও চায়নিজদের একটা লক্ষ্য। কর্নেল হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে চায়নিজদের লক্ষ্য পূরণ হয় এরকম কয়েকটা অপশন সহ একটা মেমো বানানো।
তিন) আমি গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই এর সিনিয়র সিকিউরিটি এ্যাডভাইজার। আমেরিকা আর চায়নার মারামারিতে গুগলের বিজনেসে বিশাল সব ভেজাল দেখা দিচ্ছে, চায়নিজ হ্যাকাররা গুগল হ্যাক করেছে। কিভাবে এই দুইতাকে ব্যালেন্স করে নিজেদের সিকিউরিটি ঠিক করা যায় এইটা নিয়ে মেমো লিখতে হবে।
সান জু এর আর্ট অফ ওয়ারের ভক্ত আমি, বেছে নিলাম দ্বিতীয়টা- চায়নিজ কর্নেল হিসেবে। মেমো লেখার শর্ত হচ্ছে, বাস্তব জীবনে যা ঘটেছে এর উপর ভিত্তি করে লিখতে হবে, আগড়ুম বাগরুম লিখলে চলবেনা। আমার অপশনগুলো ছিল এরকমঃ
ক) গত পরশু দক্ষিণ চায়না সাগরে আমেরিকান আর চায়নার যুদ্ধজাহাজ পঁয়তাল্লিশ ইয়ার্ডের মধ্যে চলে আসছে এবং একে ওপরের সামনে ম্যানুয়েভার করেছে। এইটা একটা বিরাট বেয়াদবি, চায়নিজ নেভাল ইন্টেলিজেন্সের উচিত আমেরিকার এই যুদ্ধজাহাজের সিস্টেম হ্যাক করে একটা দুর্ঘটনা ঘটানো। দুহাজার সতের সালে এরকম একটা দুর্ঘটনায় সতেরজন আমেরিকান নৌসেনা আহত এবং নিহত হয়েছিল, যদি কেউ স্বীকার যায়নাই কেন এইটা হয়েছিল। এই কাজটা করলে ছোটখাট কিন্তু লাউড এন্ড ক্লিয়ার একটা মেসেজ আমেরিকা পাবে।
খ) আমেরিকার অন্যতম বড় ই-কমার্স সাইট আমাজনের মধ্যে কিছু টেকনিকাল গ্লিচ খুঁজে পেয়েছে চায়নিজ হ্যাকাররা। ডার্ক ওয়েব থেকে সরকারীভাবে এইটা গোপনে কিনে জিরো ডে টেকনিক ব্যবহার করে আমেরিকার অর্থনীতিতে একটা নাড়াচাড়া দেয়া যায়।
গ) আমেরিকায় সবচাইতে উত্তপ্ত বিতর্ক হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদপ্রার্থী ব্রেট কাভানা কে নিয়ে। এই লোকের বিরুদ্ধে একাধিক যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাধ্য হয়েছে এফবিআই ইনভেস্টিগেশন চালু করতে। ব্রেট কাভানার কিছু বন্ধুবান্ধবের ফোনের কথোপকথন চায়নিজ ইন্টেলিজেন্সের কাছে আছে- নভেম্বরের ছয় তারিক নির্বাচন- তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে এই জিনিস মাস মিডিয়াতে ছড়ায়ে দিলে ট্রাম্প প্রশাসন বিরাট বেকায়দায় পড়বে বলে ধারণা করি।
রেকমেন্ডেশন হিসেবে বললাম তৃতীয়টা।বাকি দুইটায় সরাসরি আক্রমনের ব্যাপার আছে- ট্রাম্প উল্টা খেপে গিয়ে আরও বড় ভেজাল লাগাইতে পারে। তৃতীয় অপশনে চায়নার সরাসরি কিছু করা লাগবেনা, যা করার আমেরিকান মিডিয়াই করবে। কাজেই একজন সিনিয়র এ্যাডভাইজার হিসেবে এইটাই আমার ব্যক্তিগত মতামত, তবে মহান জেনারেল চাইলে অন্য যে কোনও অপশন বেছে নিতে পারেন।
এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দিসি, দেখা যাক কি আছে কপালে!
আরেকটা উল্লেকযোগ্য খবর হচ্ছে, হার্ভার্ড ল স্কুলে আগামী বছর স্প্রিং এ ব্রেট কাভানার ক্লাস নেয়ার কথা ছিল, সেইটা সে উইথড্র করেছে। সে নিজে উইথড্র করার আগেই কেন হার্ভার্ড ল স্কুলের ডীন তারে বের করে দিলো না- এইটা নিয়ে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা কিছুক্ষণ তার পিণ্ডি চটকালো। “আই বিলিভ হার” লিখে স্টিকার বানিয়ে ক্যাম্পাসের মেয়েরা সবাইকে বিলাচ্ছে, আমি একটা পেয়েছি। হুডির বুকে ওটা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আপাততঃ
আজ এ পর্যন্তই!