প্রথম সপ্তাহ পার করে আগামীকাল দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি। হার্ভার্ড আমার কাছে একটা সমুদ্রের মত মনে হচ্ছে-যেখান থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে ঋদ্ধ করার জন্য একটা পরিপূর্ণ কর্মকৌশল প্রয়োজন। এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি, রীতিমত হাবুডুবু খাচ্ছি। ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করলাম, ওদেরও নাকি একি অবস্থা!
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় যে একাডেমিক মডেল অনুসরণ করে সেটা মূলত এই হার্ভার্ড থেকেই নেয়া- কাজেই এ্যাডভাইজিং, কোর্স সিলেকশন ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। প্রিয় নর্থ সাউথ, আমার কৃতজ্ঞতা নিও!
কেনেডি স্কুলে মাস্টার্স ইন পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (২ বছর মেয়াদী) ছাত্রছাত্রীরা এক সেমিস্টারে সর্বোচ্চ বিশ ক্রেডিট লোড নিতে পারে। ডিগ্রি অর্জন করতে হলে দু বছরে মোট ৬৪ ক্রেডিট কমপ্লিট করতে হবে।প্রতি সেমিস্টারে ষোল ক্রেডিট করে নিলে চারটা সেমিস্টারে মোটামুটি মসৃণভাবেই পথ পাড়ি দেয়া যায়।একেকটা কোর্স এক ক্রেডিট থেকে শুরু করে চার ক্রেডিট পর্যন্ত হয় সাধারণত।
এই প্রোগ্রামের একটা বৈশিষ্ট্য আছে- এখানে কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই যে এতগুলো ম্যাথ কোর্স, এতগুলো ইকোনমিক্স কোর্স এগুলো নিতে হবে। তিনটা ভিন্ন ভিন্ন কোর্সগুচ্ছ ( দর কষাকষি বা negotiation, নেতৃত্ব এবং অর্থনীতি) থেকে একটা করে মোট তিনটা কোর্স নিয়ে বাকিগুলো নিজের ইচ্ছামত নেয়া যাবে। এর সুবিধা হচ্ছে, একেকজন ছাত্র নিজের পছন্দমত যে কোনও কোর্স নিয়ে সেভাবে নিজের প্রোগ্রাম নিজেই ডিজাইন করতে পারবে। আর অসুবিধা হচ্ছে আমার মত ছাত্রদের জন্য- যাদের কাছে হার্ভার্ডকে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে জ্ঞানের রেস্তোরা বলে মনে হয় – যেখানে ব্যুফে স্টাইলে ইচ্ছেমত পেট পুরে খাওয়ার অফার দেয়া! এত এত খাবার, কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল চ্যালেঞ্জ!
কোর্স নেবার ব্যাপারটাও মজার। হার্ভার্ড জুড়ে মোট এগারোটা অনুষদ আছে- হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, ল স্কুল, কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্ট( আমি এইটার ছাত্র), হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল( এইটা হচ্ছে হার্ভার্ডের সবচেয়ে নাম করা স্কুল- দি মোস্ট প্রেস্টিজিয়াস ওয়ান), হার্ভার্ড ডিভাইনিটি স্কুল ( ধর্ম নিয়ে গবেষণার জন্য এই স্কুল), গ্রাজুয়েট স্কুল অফ আর্টস এন্ড সায়েন্স ( সায়েন্স আর আর্টসের যাবতীয় বিষয় এর অধীনে) ইত্যাদি। শুধু তাই না, নন-হার্ভার্ড বলে একটা অপশন আছে- হার্ভার্ডের ছাত্ররা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হার্ভার্ডের বাইরে অন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে
(এমআইটি, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, টাফটস বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি) ক্রস রেজিস্ট্রেশন করে পছন্দমত ক্লাস নিতে পারবে।
এর মানে, আপনি শুধু আপনার নিজের বিভাগ না, হার্ভার্ডের অন্যান্য যে কোন বিভাগে কোর্স নিতে পারবেন এবং হার্ভার্ডের বাইরে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিসিয়ালি ছাত্র হতে পারবেন। আমার ইচ্ছে আছে এমআইটি তে কয়েকটা ক্লাস রেজিস্ট্রেশন করার। প্রফেসর নোয়াম চমস্কি এখনও ওখানে পড়ান কিনা জানিনা, খোঁজ নিয়ে দেখব আরকি!
আমি এই সেমিস্টারে নিয়েছি পাঁচটি কোর্সঃ
ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি- এটা হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধীনে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে এবং পেশাগত জীবন উভয় ক্ষেত্রে কিভাবে ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি অর্জন করা যায় এটা এই কোর্সের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। হার্ভার্ডে আমার প্রথম ক্লাস ছিল এটি- পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে যে জীবনের প্রথম ক্লাস করেছি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে!
বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে পুলিশিং- এটা কেনেডি স্কুলের কোর্স। ক্লাস নেবেন হার্ভার্ডের সোশিয়লজির এক প্রফেসর এবং বিভিন্ন শহরের পুলিশ কমিশনারগণ।
সাইবার যুদ্ধ- অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এটা অসাধারণ ইন্টারেস্টিং একটা কোর্স বলে মনে হয়েছে। ক্লাস নেবেন পেন্টাগনের সাবেক চীফ অফ স্টাফ। নিজের কর্মক্ষেত্রে এই ভদ্রলোক একজন লিজেন্ড- আমেরিকার নির্বাচনের সময় রাশিয়ার সাইবার এটাক সামাল দেয়ার কারণে এনাকে সহকর্মীরা সাইবার জার( Cyber Czar) বলে ডাকে। এখনও ক্লাস শুরু হয়নি, মুখিয়ে আছি এটার জন্য!
পাবলিক ন্যারেটিভ- আমি, আমরা এবং সমাজঃ এই কোর্সটা একজন লিজেন্ডারি প্রফেসরের কোর্স, হার্ভার্ডের সবচাইতে পপুলার কোর্সগুলোর মধ্যে একটা। এই ভদ্রলোক কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের পক্ষে কথা বলে হার্ভার্ড থেকে ঝরে পড়েছিলেন ছাত্র অবস্থায়। হার্ভার্ড যখন তাকে ক্লাসে ফিরে আসতে বলে তিনি তখন এক লাইনের একটা উত্তর দিয়েছিলেনঃ “How can I come back to harvard to study history when I am busy making it?” প্রায় বিশ বছর পর তিনি হার্ভার্ডে ফিরে আসেন, পড়াশোনা শেষ করেন এবং এরপর এখানে পড়ানো শুরু করেন।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়ঃ পুঁথিগত বিদ্যার চাইতে সমাজে আপনি কি অবদান রেখেছেন কিংবা রাখার সম্ভাবনা রাখেন- এই জিনিসটাই হার্ভার্ডে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়- অন্ততঃ আমার প্রোগ্রামে। উপরোক্ত প্রফেসর সমাজ পালটাতে গিয়ে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন, হার্ভার্ড তাঁর এই ত্যাগকে সম্মান জানিয়ে তাকে প্রফেসরশীপ দিয়েছে। পৃথিবীতে প্রফেসর গানজ মাত্র একজন- এবং এই লোকটার ক্লাসে গিয়ে আমার গোটা অস্তিত্ব নড়েচড়ে উঠেছিলো। ভবিষ্যতে প্রফেসর গানজ কে নিয়ে আর লেখার ইচ্ছে রাখি।
কিভাবে নির্বাচন করবেন এবং ইলেকশন ক্যাম্পেইন চালাবেন- এই কোর্সটা আমি নিয়েছি মূলত বিভিন্ন দেশের ভবিষ্যৎ নেতাদের সাথে পরিচিত হতে। গত চল্লিশ বছর ধরে এই কোর্সের প্রফেসর বিশ্বের ত্রিশটারও বেশি দেশে ইলেকশন ক্যাম্পেইন পরিচালনার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। একটা ইলেকশন ক্যাম্পেইন কিভাবে চালাতে হয়, ফান্ডিং ম্যানেজ করতে হয় কিভাবে, কখন কোন স্ট্রাটেজি নিতে হয় সব এই কোর্সে দেখানো হবে। এটাও হার্ভার্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় কোর্সগুলোর একটা। আশা করছি এই কোর্সে যাদের সাথে পরিচয় হবে তারা আজ থেকে বিশ ত্রিশ বছর পর অন্তত চার পাঁচটা দেশের প্রধানমন্ত্রী/প্রেসিডেন্ট হবে! হতদরিত্র মাসরুফ হোসেনের ক্লাসমেট অমুক দেশের প্রধানমন্ত্রী- শুনতেই ভালো লাগে হাহাহাহা!
সবশেষে একটা মজার জিনিস বলি। হার্ভার্ডে কোর্সের নিলাম হয়। মানে, যেসব কোর্স খুব বেশি জনপ্রিয়, সেসব কোর্সে সীট সংখ্যার চেয়ে ছাত্রছাত্রী বেশি থাকে। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে সাতশ করে পয়েন্ট দেয়া হয়- তারা যে কোর্স বেশি জনপ্রিয় ওইটা পেতে নিজের ইচ্ছামত পয়েন্ট বিড করে। সব সীট ভরে যাবার পর অতিরিক্ত যারা থাকে, তাদের ভেতরে সবচেয়ে বেশি যারা বিড করেছে তাদের জন্য কোর্সের সীট বরাদ্দ হয়।
আমি দুটো কোর্সের জন্য বিড করেছিলাম, দুটোই পেয়েছি।
জয় বাংলা!
আজ আপাততঃ এটুকুই!
(৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)