কালচারাল শক বলে একটা জিনিস আছে- এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আসলে এইটা হয়- যদি জায়গাটা একেবারেই নতুন হয়। এই জিনিস আমার হয়েছে গত কদিন আগে- একই দিনে দুইবার।
সন্ধ্যারটা আগে বলি। হার্ভার্ড ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কোম্পানি আসে রিক্রুটমেন্টের জন্য- ছাত্ররাও তাদের সাথে দেখা করতে যায়। আমি যাই ফ্রি খাবারের লোভে। সবাই স্যুট টাই পড়ে এসেছে, আমি এসেছি চিরাচরিত হার্ভার্ড হুডি আর জিনসের প্যান্ট পড়ে। গিয়ে দেখি বোস্টন কনসালটেন্সি গ্রুপ এসেছে রিক্রুটমেন্ট অরিয়েন্টেশন করতে।
এদেশে কনসালটেন্সি একটা বিশাল সেক্টর- এবং এই সেক্টরের তিনটা বিগ বসের একটা এই বোস্টন কনসালটেন্সি গ্রুপ বা বিসিজি( বাকি দুটো হচ্ছে বেইন আর ম্যাকেঞ্জি)।
এখানে সবাই দেখলাম পেশাগত পরিচয়ের পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও কিছুটা বলে। যে ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তিনি তাঁর স্বামী আর তিন সন্তানের কথা বললেন, কিভাবে স্বামী আর বাচ্চা ম্যানেজ করেও এখানে স্বচ্ছন্দে কাজ করেন সেটা জানালেন। এই ভদ্রমহিলার পরে এলো নিক নামে একটা ছেলে। পরিপাটি সাজগোজ করা, চুলে জেল, ছোটখাট গড়নের- দুর্দান্ত স্মার্ট। প্রেজেন্টেশন শেষে পরিবারের কথা আসতেই বলল, “আমি আর আমার স্বামী দেশ বিদেশে ঘুরতে ভালোবাসি”। আমি “স্বামী” শুনে একটু চমকে গেলাম, মনে করলাম ভুলে বলেছে। কিন্তু এর পরেই বলল, “আমার ইচ্ছা এই সামার ব্রেকে ইতালি যাবো, কিন্তু স্বামীদেবতাটি চাইছেন ঘরে শুয়ে বসে কাটাতে। এইরকম অলস স্বামী নিয়ে বিরাট বিপদেই আছি!”
এইবার মাথায় ঢুকল- নিক হোমোসেক্সুয়াল, স্বামী বলতে ওর পার্টনারকে বুঝিয়েছে। একটু পরে বলল, এই কোম্পানির এলজিবিটি সাপোর্ট নেটওয়ার্ক অসাধারণ, দারুণ কাজের পরিবেশ। শুধু শুধু তো আর গত বারো বছর ধরে গুগলের সাথে সাথে এটাও কাজ করার জন্য সেরা কোম্পানি হয়নি!
আমি হোমোফোবিক নই একেবারেই, এলজিবিটি অধিকার তীব্রভাবে সমর্থন করি। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কারো ক্ষতি না করে নিজেদের বেডরূমে কি করছে এইটা দেখা রাষ্ট্রের কাজ না বলেই আমার দৃঢ় অবস্থান। অথচ বাংলাদেশ সহ বিশ্বের আরও অনেক দেশেই হতভাগ্য এলজিবিটিদেরকে নরক যন্ত্রণায় দিন কাটাতে হয়। অবশ্য আমেরিকার সব স্টেটে যে ওরা ভালো আছে তাও না, কিন্তু ম্যাসাচুসেটস খুবী উদার, এখানে গে ম্যারেজ বৈধ।
হোমোসেক্সুয়াল শুনলে আমরা কি না কি ভাবতাম দেশে বসে- অথচ এখানে এরা শুধু স্বাধীনভাবে থাকছেই না, নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিতে চাকরি করছে এবং প্রকাশ্যে নিজের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের কথা বলছে! আরও দারুণ ব্যাপার, এ নিয়ে কারও ভেতরে এক বিন্দু উশখুশ নেই!
এলজিবিটিরা যে বাকিদের মতই স্বাভাবিক মানুষ এটা বই পড়ে জেনেছি, আগে অনেক ভুল ধারণা ছিল। এখানে প্রকাশ্যে দেখে এই সত্যতা আরও পাকাপোক্তভাবে মনে আসন গেড়ে নিলো।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি অতি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুগভীর। জন হার্ভার্ডের মূর্তির সামনে গিয়েছি লাইভ ভিডিও করতে, ডজন ডজন টুরিস্ট ওখানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে ছবি তুলবে। আমি ক্যামেরা নামিয়ে পাশে তাকিয়ে পৃথিবীর সবচাইতে স্বাভাবিক একটি দৃশ্য এক সেকেন্ডের জন্য দেখলাম- এই এত মানুষের সামনে এক মা তাঁর সন্তানকে স্তন্যদান করছেন। বিষয়টা এখানে এতটাই স্বাভাবিক, এতটাই সাধারণ যে এর ভেতরে যে কদাকার কিছু থাকতে পারে এটা এখানে কেউ কল্পনাও করতে পারেনা- তাই এরকম একটা জনবহুল জায়গাতেও এটা অতি স্বাভাবিক একটা দৃশ্য। মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম- একদিন আমাদের দেশও মেয়েদের জন্য, মায়েদের জন্য এরকম নিরাপদ হবে এই আশা বুকের ভেতর সংগোপনে জ্বালিয়ে নিল্যাম্ব অজান্তেই।
প্রফেসর মার্শাল গানজের কথা এর আগেও বলেছি- তাঁকে ছাড়া আমার এই অল্প কদিনের হার্ভার্ড অভিজ্ঞতা মূল্যহীন। উনি যে কোর্স করান এর নাম পাবলিক ন্যারেটিভ। আন্দোলনের মাধ্যমে একটা দাবী আদায় করতে গেলে যে কোনও আন্দোলনকারীকে বা পরিবর্তন প্রত্যাশীকে নিজের দাবীর কথা সবাইকে জানাতে হয়, একটা গল্প তৈরি করতে হয়। এই গল্প বানোয়াট চাপাবাজি না, নিজের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বের করে আনা সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষার সাথে গনমানুষের প্রত্যাশাকে একাকার করে দিয়ে সৃষ্টি করা একটা ন্যারেটিভ, যে ন্যারেটিভ মানুষকে নাড়া দেবে, দাবী আদায়ে মাঠে নামতে উদ্বুদ্ধ করবে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এই দাবী ছিল “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”। এই দুটি লাইন দিয়ে তিনি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ভিত্তিমূল, মর্মমূলে প্রবেশ করেছিলেন প্রতীতি মুক্তিকামী বাঙালীর। প্রফেসর গানজের রিসার্চের বিষয় হল এই ন্যারেটিভের চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং কিভাবে একজন সাধারণ মানুষ তার নিজের ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারে তার প্রশিক্ষণ। বারাক ওবামার ক্যাম্পেইনের “চেইঞ্জ উই ক্যান বিলিভ ইন” কথাটি যে লোকের মাথা থেকে বেরিয়েছে, এই লোকের প্রতিটা শব্দ অমূল্য। আমি ক্লাসের একেবারে সামনের বেঞ্চিতে বসি যাতে পুরো ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখতে পারি।
আমেরিকা স্বর্গরাজ্য না। এখানে রেইসিজম আছে, ভয়াবহ সব অপরাধ হয় এখানে। এদের ফরেন পলিসি থেকে শুরু করে গোটা দুনিয়াতে মাতব্বরি করার যে অভ্যাস, এগুলোর অনেক কিছুই দুই চোখে দেখতে পারিনা। কিন্তু একটা জিনিস এদের আছে, স্রেফ এই একটা জিনিস নিজের চোখে দেখতে আমার এই দেশে আসা। জিনিসটার নাম বাকস্বাধীনতা।
হার্ভার্ড আমেরিকার প্রথম সারির একটা বিশ্ববিদ্যালয়- এখানে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই গোটা আমেরিকাকে নাড়া দেয়। এইখানে বসে, অর্ধশতাধিক দেশের ছাত্রছাত্রীদের সামনে আমার প্রাণপ্রিয় প্রফেসর মার্শাল গানজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন।
পার্ডু থেকে পাস করা আমার এক বড়ভাই আছেন- ইয়ামেন ভাই। বিদ্বান মানুষ, আমেরিকান আর্মিতে ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন, উনার কমান্ডার ইন চীফ হচ্ছেন এই ট্রাম্প বাবাজী। ইয়ামেন ভাই ব্রেকফাস্টে কখন আছেন এইটা আপনি বুঝতে পারবেন উনার ফেসবুক ওয়াল দেখলে। যখনই দেখবেন ট্রাম্পের জাত পাত তুলে গালাগালি চলতেসে, বুঝবেন বড়ভাই হয় ব্রেকফাস্ট নাহলে লাঞ্চে আছেন। উনার কথা ক্লাস শেষে প্রফেসরকে বললাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম- “ প্রফেসর, এই যে দেশের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের এইভাবে সমালোচনা করতেসো, এতে তোমাদের সমস্যা হয়না ?”
উনি বললেন- “আগামী ক্লাসে আরও দশগুণ সমালোচনা আসবে খেয়াল রেখো। দরকার হলে এইটা ওই *****কে (লেখার অযোগ্য) জানিয়ে দিও। দেখবো ও আমার কি *** করে”।
আর কিচ্ছু না, আমার মাতৃভূমির জন্য পারলে শুধু এই চর্চাটা নিয়ে যেতাম!