মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ার্কআউট এবং ডায়েট রেজিম
কিভাবে ব্যায়াম করতেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা?? কি খেতেন তাঁরা??
সুপ্রিয় স্বপ্নযোদ্ধারা,
আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যখনই কোনও বাধার সম্মুক্ষীণ হই, শুধু একটা জিনিস মাথায় রাখি- ইজ ইট টাফার দ্যান ফেইসিং আ মার্ডারাস, প্রফেশনাল আর্মি? প্রায় বিনা ট্রেনিং-এ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাক আর্মির মুখোমুখিই শুধু হননি, এই দানবদের পরাজিত করে জন্ম দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের- যে বাংলার মাটিতে আজ আপনি আমি দাপিয়ে বেড়াই। জীবনে যে বাধাই আসুক, এটা তাঁদের দেখানো উদাহরণের চাইতে কঠিন নয়। আমাদের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আলোকবর্তৃকাবিশেষ, যে আলোকরশ্মিতে দূর করা সম্ভব যাবতীয় অন্ধকার।
আমার পরম সৌভাগ্য, আজ কথা বলতে পেরেছি কিংবদন্তীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর Wakar Hassan বীর প্রতীক স্যারের সাথে। সম্মুখ সমরে অষ্টাশি জন পাক হানাদার খতম করা এই বাঙালী বীরের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা শুনছিলাম আর শিউরে উঠছিলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা আলাপচারিতার একটা ছোট অংশ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ফিজিকাল ফিটনেস সংক্রান্ত ট্রেনিং নিয়ে। প্রশ্ন রেখেছিলাম, কি ধরণের ট্রেনিং আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নিয়েছিলেন যার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার মত অতিমানবিক কাজটি তাঁরা সম্পন্ন করেছিলেন?
ওয়াকার স্যারের সাথে আলাপচারিতায় মোটামুটি ধারণা পেলাম কি ধরণের ফিজিকাল কন্ডিশনিং মুক্তিযোদ্ধাদের করানো হত, যার উপর ভিত্তি করে আজকের লেখাটি।
একটা জিনিস পরিষ্কার, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ডায়েট পালনের কোন সুযোগ ছিলনা বললেই চলে। তাঁরা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতেন, আহত অবস্থায় লড়াই করতেন, ক্ষুধায় সুযোগ পেলে প্রচুর পরিমান সুগার এবং কার্ব খেতেন। বাজার থেকে জিলাপী, মিষ্টি খাবার গল্প আমি ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলা ফতেহ আলী স্যারের কাছেও শুনেছি।বাঙালিদের স্বভাবজাত খাবার ভাত খাবার ক্ষেত্রে স্বভাবতই কোন বাধা ছিলনা- বরং পেট ভরেই খেতেন তাঁরা।
এ পর্যন্ত সম্মুখ সমরে লড়া মুক্তিযোদ্ধাদের যত ছবি দেখেছি, ফিজিকালি আনফিট বা মেদবহুল কাউকেই চোখে পড়েনি। এর কারণ হিসেবে ওয়াকার স্যার কয়েকটা বিষয় তুলে ধরেছেনঃ
এক) বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন বয়েসে তরুন, প্রচন্ড দেশপ্রেমের উদগ্র বাসনায় শারীরিক কোন বাধাই কাজ করতনা তাঁদের ভেতরে। দেশ স্বাধীন করার মানসিক ইচ্ছা এতটাই সুতীব্র ছিল, এর সামনে শারীরিক কষ্ট পাত্তা পেত না। শত্রু অধিবেষ্টিত হবিগঞ্জ অঞ্চলের চল্লিশ মাইল ভেতরে ঢুকে অপারেশন করে তাঁরা সেই দিনই ক্যাম্পে ফেরত যেতেন- কলা পানির ভেতরে প্রচণ্ড শীতে, মশা মাছির কামড়, জোঁকের রক্তচোষায়- এগুলোর কোনওকিছুই তাঁদের আটকাতে পারতনা।
দেশ স্বাধীন করতে চান কিংবা ফিজিকাল ফিটনেস অর্জন করতে চান- কঠোর ডিটারমিনেশনের কোন বিকল্প নেই। প্রতিজ্ঞা করুন আপনি কাজটা করবেন- দেখবেন ঠিকই করতে পারছেন।
“ভাইয়া, ডায়েট দেখে সবাই হাসে কি করব” “ভাইয়া,দশটা মিষ্টির বদলে সাড়ে নয়টা মিষ্টি খাচ্ছি আমার কি ওজন কমবে?” অথবা ” কাচ্চি দেখলেই খাই-ঠেকাতে পারি না- এর সমাধান কি”
—- এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এটি।
ইফ য়ু রিয়েলি মীন ইট, য়ু উইল ডু ইট।
দুই) শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বইতে পাই শহীদ রুমীর যুদ্ধকালীন খাবারের বর্ণনা- ছোকলা সুদ্ধো ডাল এবং শক্ত রুটি । প্রিয় পাঠক, খেয়াল করুন- শক্ত রুটি দেবার পেছনে একটা কারণ হতে পারে এটা হজম করতে প্রচুর সময় নেয়া।
আমরা ভাতের বদলে ওটমিলস এ কারণেই খাই যে এটা পেটে অনেকক্ষণ থাকে, কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট হিসেবে।সাদা ভাত খেলে তা দ্রুত হজম হয়ে যায়, রক্তে ইনসুলিন নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ফলশ্রুতিতে ফ্যাট জমতে থাকে।
কার্ব যদি খেতেই হয়- সাদা ভাত, ময়দা বা রিফাইনড কার্বোহাইড্রেটের তৈরি সাদা রুটি ইত্যাদির বদলে শক্ত, ভুষিসহ গমের রুটি অথবা ওটমিল( এইটা সব জায়গাতেই আজকাল পাওয়া যায়) খেয়ে নিলে ফ্যাট জমার প্রক্রিয়া গতি পায়না।পেটও অনেকক্ষণ ধরেই ভরা থাকে।
তিন) মেজর ওয়াকার স্যারের বর্ণনায় পাই, ভোর পাঁচটা থেকে ছয়টা- এই এক ঘন্টা মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়াতেন এবং নানারকম ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বপ্রথম যুদ্ধকালীন কমিশনের ট্রেনিং ছিল দিনে প্রায় আঠারো ঘন্টা-তিন মাস ধরে।এক ঘন্টা ফিজিকাল এক্সারসাইজের পর ব্রেকফাস্ট, ব্রেকফাস্টের পর দিনের বাকি সময় আর্মস ট্রেনিং, ডেমোলিশন ট্রেনিং, ব্যাটেল ট্যাকটিক্স ট্রেনিং ইত্যাদি হত।
দৌড় হত নানা রকমের। এর আগের লেখায় স্প্রিন্ট ট্রেনিং এর যে বর্ণনা দিয়েছিলাম তার সাথে কিছুটা মিল রয়েছে। পাহাড়ী রাস্তার উপর দিয়ে দৌড় এবং এর মাঝে নানান ধরণের ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, টাচ এ্যান্ড ব্যাক- একটা লক্ষ্য দৌড়ে ছুঁয়ে আবার আগের স্থানে ফিরে আস্ পুশ আপ, ক্রলিং ইত্যাদি।
ছবিতে এরকম একটা মিলিটারি ক্যাম্পের সার্কিট ট্রেনিং সংযুক্ত করে দিয়েছি, যার পদক্ষেপগুলো (কিছুটা মডারেট করা) অনেকটা এরকমঃ
এক) প্রথমে প্রচন্ড জোরে দৌড়ে একটা ছোট টিলার উপরে বেয়ে উঠবেন।টিলা বা পাহাড় না থাকলে দুই মিনিট সর্বশক্তিতে একটা সমতল স্থানে দৌড়াবেন- যাঁরা উঁচু বিল্ডিং এ থাকেন তাঁরা নীচ তলা থেকে খুব জোরে দৌড়ে ছাদে উঠতে পারেন যদি সুযোগ থাকে। সেখানে গিয়ে দশটা ( সম্ভব হলে বিশটা- না পারলে পাঁচটা দিয়ে শুরু) পুশ আপ দেবেন।
দুই) দৌড়ে শুরুর স্থানে ফিরে যাবেন এবং বিশটা স্কোয়াট জাম্প করবেন।
তিন) আবার দৌড়ে পূর্বের স্থানে ফিরে যাবেন এবং বিশটা বাইসাইকেল ক্রাঞ্চ করবেন।
চার) সর্বশক্তিতে দৌড়ে শুরুর স্থানে ফিরে যাবেন এবং বিশটা “টাক জাম্প (Tuck Jump)” করবেন। টাক জাম্প হচ্ছে লাফিয়ে হাঁটু দিয়ে বুকে বাড়ি দেবার ব্যায়াম (ছবি সংযুক্ত)।
পাঁচ) এবার আবার পূর্বের স্থানে দৌড়ে গিয়ে বিশটা “বারপী( Burpee)” করবেন ( ছবি সংযুক্ত)
ছয়) সবশেষে, সর্বশক্তিতে দৌড়ে শুরুর স্থানে ফিরে যাবেন।
এই ছয় ধাপের সার্কিটটি হচ্ছে মোটামুটি ট্রেনিং ক্যাম্পের একটা সার্কিট ট্রেনিং এর উদাহরণ। এটাকে আপনি নিজের সুবিধামত নানাভাবে নানারকম এক্সারসাইজ দিয়ে সাজিয়ে নিতে পারেন। সিলেটের স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি এ্যান্ড ট্যাকটিকসে “টাইগার চেইজ” নামে একটা সার্কিট সেনা কমান্ডোরা করেন, যেটাতে সাতটা টিলা এভাবে দৌড়ে পার হতে হয়। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের রিক্রুটমেন্টের সময়েও এরকম শুরুতে এক মেইল দৌড় ( মেইল টেস্ট) এবং তারপরে বিভিন্ন রকমের এক্সারসাইজ দিয়ে সার্কিট টেস্ট নেয়া হয়ে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটা এক্সারসাইজ করতেন- অস্ত্র হাতে ক্রলিং। আপনার হাতে একটা লাঠিকে অস্ত্রের মত ধরে কিংবা খালি হাতেও ক্রলিং করতে পারেন। মাঠে বা ছাদের উপরে – অল্প একটু জায়গাতে ক্রলিং খুবই সম্ভব। ছবি সংযুক্ত করে দিচ্ছি, ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও আছে দেখে নিতে পারেন। ক্রলিং করলে দেহের মিডসেকশনের সাথে সাথে সারা দেহের কাজ হয়- প্রচন্ড এফেক্টিভ একটা এক্সারসাইজ।
প্রিয় পাঠক, খেয়াল করুন- এক ঘন্টার এক্সারসাইজে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা একটা দেশ স্বাধীন করেছেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও কিন্তু তাঁদেরকে শরীরের যত্ন নিতে হয়েছিল।
আপনি নেবেন না কেন? ফিজিকাল ফিটনেস অর্জন করা কি মৃত্যুর মুখোমুখি হবার চাইতেও কঠিন???
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন। ব্যায়াম করার সময় যখন খুব কষ্ট হয়, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভাবি- ল্যাকটিক এসিডের আধিক্যে যখন মাংসপেশী ছিঁড়ে যাবার মত অনুভূতি হয়, তখন আমি ভাবি গুলিবিদ্ধ হাত নিয়ে মুক্তিসেনার গ্রেণেড নিক্ষেপের চিত্র। আমাদের কিংবদন্তীর অধিনায়ক মাশরাফি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা চিন্তা করে লিগামেন্ট ছেঁড়া পা নিয়েও দৌড়ান- সেখান থেকে এই আইডিয়াটা পাওয়া।
You see, its all about high morale, its all about the fighting spirit.
মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বড় স্পিরিটের উৎস আর দুটো আছে কি??
লেটস ডু ইট!!!
প্রথম প্রকাশিতঃ ১৬ই মার্চ, ২০১৬