আচ্ছা, আর কতগুলো ধর্ষণ আর হত্যা হলে আমাদের মনে হবে এনাফ ইজ এনাফ? ধর্ষিতার জামাকাপড় আর চলন বলনের অজুহাত দিয়ে ধর্ষণকে জায়েজ করার “চুতিয়াপনা” (এর চেয়ে খারাপ শব্দ আমার জানা নেই, জানলে সেটাই ব্যবহার করতাম) চলবে আর কতদিন ধরে?
ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতরে নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ আবিষ্কার হবার পর সেই একই চক্রাকার দোষারোপ আবার দেখতে পাচ্ছি- “মেয়ে নাটক করত, চলাফেরা ঠিক ছিলোনা- এইটা তো হবেই”।আরও একটা ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি- সারা পৃষ্ঠাজুড়ে প্রতিবাদ ছাপানোর কথা যাদের তাদের অনেকের রহস্যময় নীরবতা।
খুব সংক্ষেপে কয়েকটা বিষয় তুলে ধরিঃ
এক) ধর্ষণ/শ্লীলতাহানি কখনোই ভিকটিমের দোষ না। “নাটক-ফাটক করলে, রংঢঙ কইরা বেড়াইলে এইরকম তো হইবই”- এই যদি আপনার মনমানসিকতা হয় তাহলে আপনার স্থান সভ্য সমাজে নয়, জেইলে।You, Sir, are a criminal in hiding. সুযোগের অভাবে ধর্ষন করতে পারছেন না মাত্র, আপনার হাতে আপনার মা-ও নিরাপদ না।
দুই) “ধর্ষণ করাটা চরম অপরাধ, মেরে ফেলার প্রতিবাদ আমিও করি , “কিন্তু”, মেয়েদেরও উচিত চলাফেরা ঠিক করা, সতর্ক থাকা”- এই কথা বলার মানে হচ্ছে আপনি মনে মনে ওই ধর্ষণের কথা চিন্তা করে লোল ফেলছেন। অসহায় মেয়েটার ওই মুহূর্তের নরক যন্ত্রনা কল্পনা করে আপনার শরীরের অঙ্গবিশেষ উত্থিত হয়ে যাচ্ছে।
পুলিশি অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই আপনার মত মানুষেরাই বাসে সুযোগ পেলে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়, প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে ছাত্রীর উপর চড়াও হয়, বাসার কাজের মেয়েটাকে নির্যাতন করে, বেড়াতে আসা খালাতো বোনকে অন্ধকারে জাপটে ধরে। আপনি একটা অমানুষ, একটা সাড়ে হারামজাদা। এটা মধ্যযুগ হলে তপ্ত লৌহশলাকা দিয়ে আপনার শিশ্ন উৎপাটন হত যথোপযুক্ত শাস্তি।
প্রিয় পাঠক, আপনারা যাঁরা মনে করেন যে আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর
(ইউরোপ, আমেরিকা বা পাশের দেশ ভারত) তুলনায় নৃশংসতা এবং নারী নির্যাতনে পিছিয়ে আছে- আপনারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। তথাকথিত সামাজিক কারণে আমাদের দেশে ধর্ষিতা মুখ খুলতে চায় না, বাবা মা-ও চেপে যায়। অন্ততঃ হাফ ডজন বান্ধবীর কাছে শুনেছি, তাদের আপন মামা, চাচা, খালুর কামলালসা থেকে তারা রক্ষা পায়নি। যখন মা বাবাকে জানিয়েছে, তারা উলটো তাকেই দোষারোপ করে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন।
দুটো ঘটনা আমি নিজে ডীল করেছি যেখানে মেয়ে তার আপন বাবার হাতে নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জ্বি, আমি বাংলাদেশের কথা বলছি।
একজন ভাই হিসেবে, কন্যাসন্তানের ভবিষ্যত পিতা হিসেবে আমার বোন বা মেয়ের কথা ভেবে আমি আতঙ্কিত হই। এরকম একটা সমাজে তারা কিভাবে বসবাস করবে এই চিন্তা আমাকে শিহরিত করে তোলে।মিডিয়াতে আসে না বা রিপোর্টেড হয়না- এর মানে এই না যে ভয়ংকর এই অপরাধগুলো এই সমাজে ঘটছে না।
তনুর ঘটনাটি বিশাল হিমশিলার দৃশ্যমান চূড়া মাত্র।এজাতীয় ঘটনা সেনানিবাসে ঘটুক, থানার ভেতরে ঘটুক কিংবা রাজপ্রাসাদে ঘটুক- এবং যেই ঘটাক, আমি তার গা শিউরে ওঠা পরিণতি কামনা করি।
আপনার পরিবারের কেউ ধর্ষণ/শ্লীলতাহানির শিকার হলে যদি সমাজের ভয়ে সেটা চেপে যান, মনে রাখবেন- আপনি কিন্তু ওই ধর্ষকের সহযোগী হিসেবে কাজ করলেন।”সমাজ” বলে কিচ্ছু নেই যদি সেটা একটা অন্যায়কে ধামাচাপা দিতে সহায়তা করে। সকালে হাঁটতে যাওয়ার পার্টনার, পাশের বাসার ভাবী আর অফিসের কলিগ আপনার মেয়ের সম্পর্কে কি কুমন্তব্য করল তার চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আপনি আপনার মেয়ের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেন কিনা সেটা।
প্রতিবাদের ঝড় ইতোমধ্যে উঠেছে- তথাকত্থিত সুশীল কিছু মিডিয়ার সুবিধাজনক নীরবতা সত্ত্বেও। একজন ভাই হিসেবে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে- আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে আমার প্রতিবাদটুকু জানিয়ে গেলাম।
ক্রিকেটের উন্মাদনায় এর চাইতে হাজার গুণ গুরুত্বপূর্ণ এ অন্যায়টি যেন চাপা না পড়ে।
নপুংশক নীরবতার সংস্কৃতি দূর হোক, যার যার অবস্থান থেকে হোক প্রতিবাদ, ধর্ষণমুক্ত হোক আমার বাংলা মা!
প্রথম প্রকাশিতঃ ২৩শে মার্চ, ২০১৬