২০০৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৩ দশমিক ৬ সিজিপিএ (৫ এর স্কেলে) নিয়ে আমি এইচ এস সি পাস করি। কেমিস্ট্রিতে বি, ম্যাথেও ওইরকম একটা কিছু। ভালো কোথাও চান্সও পাইনাই,বুয়েটে পরীক্ষা দেয়ার সিজিপিএ ছিলোনা।
এইচ এস সিতে খারাপ রেজাল্ট করা এবং ভালো কোথাও চান্স না পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা জানেন, আমাদের সমাজ কি আচরণ করে এদের সাথে, নিকটাত্মীয়েরা এমনিতেই ভেংগে পড়া একটা ছেলে/মেয়েকে কিভাবে আরো বেশি করে মাটিতে পিষে ফেলতে চায়।
খুব কম মানুষই তাকে বোঝায়, জীবনটা অনেক বড়, এইচ এস সি পরীক্ষায় খারাপ করার মানেই জীবনের পরীক্ষাতে ফেল করা না।
“তোদের ছেলে ক্যাডেটে পড়েও কোনমতে পাস করল, কোথাও তো চান্সও পাবেনা, দেখ পয়সা দিয়ে কিছু করতে পারিস কিনা, ব্রেন তো আর নাই, পয়সাই ভরসা”
অথবা, ” সায়েন্স পড়তে গেসে কেন, গাধা ছেলেপুলে আর্টস নিয়ে পড়লেই তো আর এই সমস্যা হয়না”
কথাগুলো পরিচিত লাগে কি?
আমার নিত্যদিনের সংগী ছিল এগুলো। আব্বু আম্মু একেক দিন একেক দাওয়াতে যেত, আর নতুন করে শুনে আসত এসব। আম্মুর কান্না আর আব্বুর দীর্ঘশ্বাস, এতদিন হয়ে গিয়েছে, তবুও এই সুদূর জাপানে বসেও প্রায়ই কষ্ট দিত আমাকে। স্বপ্ন দেখতাম, সব মুছে দেব একদিন।
গতকাল ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ছিলো, সে উপলক্ষে একটা লেখা দিয়েছিলাম। একজন ক্যাডেটের ভেতরে কিভাবে নেতৃত্বের গুনাবলী গড়ে ওঠে, কিভাবে যে কেউ এই গুনগুলো অর্জন করতে পারে, সেটার উপর।
খুব অবাক বিস্ময়ে এবং আনন্দের সাথে দেখলাম, আমার বাবা এই লেখাটি পড়েছেন। শুধু তাই না, এই এগারো বছর পর তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, আমার এইচ এস সি রেজাল্ট নিয়ে তিনি কোন দুঃখ মনে পুষে রাখেননি।
সারাজীবন বাবা-মায়ের কাছ থেকে শুধু নিয়েই গিয়েছি,কিছু দেয়ার সুযোগ হয়নি। বাপের হোটেলে থাকি আর খাই বলে নিশ্চিন্তে পুলিশিং করতে পারি,কুচিন্তা মাথায় ঢোকার সুযোগ পায়না।
আমার বাবা সিভিল সার্ভিসে ছিলেন ত্রিশ বছর, ভয়াবহ রাশভারী মানুষ। উনার কাছ থেকে এই এগারো বছর পর এই কথাগুলো আমার মত মানুষের জন্যে মোটামুটি অস্কার পাওয়ার মত অর্জন।
এই এগারো বছর পর তাই নিজেকে বেশ ভারমুক্ত বলে মনে হচ্ছে। থ্যাংক্স,আব্বু!
সবশেষে, এইচ এস সি পরীক্ষা /ভর্তিযুদ্ধ অথবা জীবনের যে কোন একটা লড়াইয়ে ধরা খাওয়া সবাইকে বলি, “ডারো মাত,তেরা ভি টাইম আয়েগা।”
রবিবাবুর গান মনে নাই?
“বজ্র যেমন বেগে, গর্জ্বে ঝড়ের মেঘে
অট্টহাস্যে সকল বিঘ্ন-বাধার বক্ষ চেরে”
সাউথ ইন্ডিয়ান ভিলেন প্রকাশ রাজের (সিংহাম, ফার্স্ট পার্ট) মত অট্টহাসি হেসে জীবনের এইসব ছোটখাটো বাধাবিপত্তি উড়িয়ে দেয়ার সময় আপনারও আসবে।
আমার লেগেছে মাত্র ১১ বছর। আমার মত মাথা গরম মানুষ যদি ১১ বছর অপেক্ষা করতে পারে, আপনিও পারবেন। হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিলাম, বিফলে মূল্য ফেরত।
শুধু একটাই অনুরোধ, লড়াই থামাবেন না।
খবরদার!
প্রথম প্রকাশিতঃ ২০শে অক্টোবর, ২০১৪