একজন সাকিবিয়ান বলছি

আমার ক্রিকেট খেলা দেখার বয়েস খুব বেশি নয়, মাত্র ৯৬ বিশ্বকাপ থেকে ক্রিকেট দেখছি। খুলনা জিলা স্কুলের ছাত্র আর বড়মাঠের সামনে বাসা-এদুটোর কারণে ক্রিকেট ওয়াজ মাই আল্টিমেট চয়েজ। পুলিশ না হয়ে অন্যকিছু হবার সুযোগ থাকলে কি হতে চাইতেন সেটা কেউ জিজ্ঞাসা করলে নির্দ্বিধায় বলে দিই, ক্রিকেটার হতাম। ক্লাস সেভেনে বিকেএসপিতে ভর্তি হবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তৎকালীন বাস্তবতায় ভর্তি হই ক্যাডেট কলেজে। এরপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পুলিশে যোগদান এবং বর্তমানে জাপান।

ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা এক সময়ে অনেকটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ছিল, বল-টু-বল টেস্ট ম্যাচ দেখতাম নাওয়া খাওয়া ভুলে। যে দেশেরই খেলা হোক, টিভির সামনে বসা চাই। আর ক্যাডেট কলেজের কমন রূমে দল বেঁধে খেলা দেখা, তারও আগে খেলা দেখার পারমিশন পাওয়ার জন্যে অথরিটির সাথে পুরো কূটনৈতিক মেজাজে দরকষাকষি- আহ, কি সব দিন ছিল সেগুলো!

ইচ্ছে থাকলেও জীবিকার তাগিদায় সব দলের সব ম্যাচ দেখা অসম্ভব, কিন্তু এই কাজটা আমার জন্যে সহজ করে দিলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমার দেশ নিয়মিত খেলতে শুরু করার পর আমার বিরাট সুবিধা, শুধু বাংলাদেশের ম্যাচ দেখি। কালেভদ্রে কোন লিজেন্ড টাইপ খেলোয়াড়ের খেলা থাকলে খেলার চ্যানেলে চোখ রাখা, এছাড়া বাকি সময়টা সেই দায় থেকে রক্ষা!

সেই আইসিসি যুগ থেকে বাংলাদেশের খেলার সময় চাতক পাখির মত বসে থাকতাম। আমি আর আমার বাবা তখন কি ভয়াবহ উত্তেজনায় আলোচনা করতাম আমাদের খেলোয়াড়দের টিভিতে দেখাবে, তাদের পোশাক কিরকম হবে এগুলো! পোশাকের ডিজাইন নিয়ে কথা বলার সময় মা-ও যোগ দিতেন, নিজের মতামত দিতেন কোন জার্সিতে আমাদের ছেলেদের সবচাইতে সুন্দর দেখাবে।

এযুগে জন্ম নেয়া সৌভাগ্যবান ক্রিকেট দর্শকেরা কখনো জানতে পারবেনা, নিজ দেশের খেলোয়াড়দের মুখ, খেলার ধরণ- এগুলো টিভিতে দেখতে পারাও আমাদের জন্যে তখন কত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল!

এর পর পদ্মা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বহু জল, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মুকূটে যুক্ত হয়েছে একের পর এক সাফল্যের রাজটীকা। ১৯৯৯ সালের পাকিস্তানকে হারানো (এখানে “খেলার সাথে রাজনীতি” ইচ্ছে করে মেশাচ্ছি-নাকে খৎ দিয়ে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত পাকিবরাহকূলের প্রতি প্রেম দেখানোর কোন কারণ আমি অনুভব করিনা) দিয়ে উল্লাস শুরু, অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে সবকটি দলকে হারানো- বাংলাদেশের একেকটা জয় আসে আর আমরা যাবতীয় ভেদাভেদ ভুলে উল্লাসে মেতে উঠি, যার সর্বশেষ সংযোজন আজকের জিম্বাবুয়ের সাথে টেস্ট জয়।

এই জয়ের নায়ক সাকিবকে নিয়ে আজ সবাই উল্লাসিত, আমিও। আমার মনে হয় সাকিবকে নিয়ে একজন ভক্ত হিসেবে মনের কথাগুলো প্রকাশ করার আজ একটা মোক্ষম সময়।

সাকিবের সাথে আমার প্রথম সরাসরি দেখা ২০১২ সালে। ঢাকায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন সময়ে প্রতিটি দলের সাথে এএসপি পর্যায়ের একজন অফিসার থাকেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে। আমার অসীম সৌভাগ্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাংলাদেশ সফর চলাকালীন দুদিন এই দায়িত্ব আমার উপর পড়েছিল, টিম সিকিউরিটি অফিসার (টিএসও) হিসেবে একদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর আরেকদিন বাংলাদেশ দলের সাথে ছিলাম। খেলোয়াড়দের হোটেল থেকে তুলে নিয়ে বাসে তাদের সাথে থাকা, ভেন্যুতে ঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া এবং খেলা শেষে বাসে করে তাদের হোটেলে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সর্বক্ষণ তাদের সাথে থাকা- এই হচ্ছে দায়িত্ব।

মিডিয়াতে সাকিব আর তামিমকে “বেয়াদব” ইত্যাদি ট্যাগ লাগাতে শুনি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাহলে বলিঃ

বোনের জন্মদিন কদিন পরেই, ঠিক করেছি এমন কিছু দেব যা আর কেউ ওকে দিতে পারবেনা। সাকিব আর তামিম বসেছিল আমার ঠিক পেছনের সীটে। ওদের দিকে ঘুরে বললাম, “ভাই, আমার ছোটবোনের জন্মদিন সামনে, ওকে একটু শুভেচ্ছা জানাবেন? ও আপনাদের অনেক বড় ফ্যান। তামিম অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল, সাকিব ডাক দিল, “এই তামিম, শোন”।

যে দুজন তারকার এক সেকেন্ড সময় পাওয়ার জন্যে দেশ বিদেশের কর্পোরেট রথী মহারথীরা হন্যে হয়ে ঘুরেও অনেক সময় খোঁজ পায়না, এই দুজন মানুষ তাদের সিকিউরিটির দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা এই আমার বোনের জন্যে হাসিমুখে পোজ দিলেন, আমার বোনের নাম ধরে শুভেচ্ছা জানালেন, আর আমি আমার সস্তা মোবাইল ফোন দিয়ে সেটা ভিডিও করে নিলাম।

আমি পুলিশে চাকুরি করি বলে আমার ছোটবোন মাঝে মাঝেই আমাকে ক্ষ্যাপাতো, এদেশের পুলিশের “রেপুটেশন” এর কারণে। কিন্তু ঠিক ওইদিনের পর থেকে তার ধারণা হল তার ভাই সুপারম্যান, বোনের প্রয়োজনে দুনিয়া থামিয়ে দেয়, বাঘের চোখ এনে দেয়।

একজন ভাইয়ের কাছে এটা কতবড় প্রাপ্তি, যাঁদের বোন আছে তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমাকে এই অবিস্মরনীয় অনুভূতিটুকু অনুভব করার সুযোগ করে দিয়েছিল মিডিয়ার “বেয়াদব” ওই সাকিব আল হাসান। সাকিব ভাই, কখনো মুখ ফুটে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি আপনাকে, আজ জানাচ্ছি।

ক্রিকেট খেলাটাকে আমি ভালবাসি জীবনের সাথে এর বেসম্ভব রকমের মিলের কারণে। জীবনে যেমন, ক্রিকেটেও তাই- সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নেরা ফিনিক্স পাখির মত পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে বার বার জন্ম নেয় নতুন করে, ফিরে আসে বীরের বেশে। রবিঠাকুরের ভাষায়, “বজ্র যেমন বেগে, গর্জ্বে ঝড়ের মেঘে, অট্টহাস্যে সকল বিঘ্ন-বাধার বক্ষ চেরে” আমাদের চ্যাম্পিয়ন সাকিবও তেমনি নিষেধাজ্ঞার জবাব দেয় মাঠের পারফরম্যান্সে, একই টেস্টে সেঞ্চুরি আর দশ উইকেট নিয়ে ইয়ান বোথাম আর ইমরান খানদের পাশে নিজের নাম লিখিয়ে। সাকিবকে যারা বেয়াদবের তকমা লাগিয়ে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন, সেসকল বরাহকুলের জন্যে সাকিবের পারফর্ম্যান্স যে বজ্রাঘাতের মতই, তা এই সুদূর টোকিও থেকেও খুব অনুভব করতে পারছি!

পুলিশি চাকুরির যে সুবিধাটির কথা শুরুতেই বলেছিলাম, দুর্দান্ত কিছু মানুষের সাথে সরাসরি দেখা করার সুযোগ আছে এই পেশায় প্রায় প্রতিনিয়তই। নিজেদের ফিল্ডে জায়ান্টরূপে পরিচিত এই লোকগুলোর ভেতরে আমি বেশ কিছু জিনিস কমন দেখেছি, এবং সাকিবও সেই গুনগুলো মনের গহীনেই ধারণ করে।

আপনার প্রতি অন্যায় হয়েছে দেখে কান্নাকাটি করছেন? শুনুন জনাব, এই দুনিয়াটাতে আপনি আগে আসেননি, দুনিয়াটা এসেছে আপনার আগে। “Life is not fair, get used to it”-এটা বিল গেটসের কথা।

বাংলাদেশের এই আপনার আমার মত মাছ ভাত খাওয়া একটা ছেলে আজ সারা বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। মাগুড়া জিলা স্কুলের মাঠে খেলা শেখা শুরু করা এই ছেলে আজকে সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে বেড়ায়, শাসন করে ক্রিকেট-বিশ্ব। বাসে উঠে এই ছেলে ঠিক আপনার আমার মতই আঞ্চলিক ভাষায় বকাসকা দেয় টিমমেটকে। আপনার আমার সাথে এই ছেলেটার খাওয়াদাওয়া, বেড়ে ওঠা, পরিবেশ- কোনটারই পার্থক্য নেই, বরং হিসেব করে দেখলে আমাদের চাইতে সুযোগ সুবিধা শুরুর দিকে কমই পাওয়ার কথা ওর।

আপনার-আমার সাথে ওর পার্থক্যটা কি বলুন তো? ওর এ্যাটিচিউড।

আমাদের সাকিব অতিমানব নয়, ভুলত্রুটি তারও হয়। কিন্তু এই ভুলত্রুটি করে সে ভেংগে পড়েনা, নিজের প্রতি বিশ্বাস হারায় না। ওরও মেজাজ খারাপ হয়, চিমটি দিলে ও ব্যাথাও পায়, কষ্ট পেলে কাঁদে। এই ছেলেটা তারকাখ্যাতির কারণে আকাশে ভেসে ধরাকে সরা জ্ঞান করেনা, সেঞ্চুরি করার পর গরীব গ্রাউন্ডসম্যানদেরকে ৫০,০০০ টাকা বকশিস দেয়।

“আমাকে ব্যান করেছে? বেশ করেছে- ওরকম খারাপ সময় সবার আসে। জবাবটা মাঠে করে দেখাবো, সেজন্যে মাঠের আড়ালে্র প্র্যাকটিসে সর্বশেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব। চোখের জলে গা না ভাসিয়ে পরিশ্রমের ঘামে পরবর্তী সুযোগকে করে নেব আগের চাইতেও মধুরতম”।

দিস ইজ কল্ড সাকিবিয়ান এ্যাটিচিউড। দিস ইজ কল্ড ইনভিক্টাস মাইন্ড- অপরাজেয় মন।

প্রতিটা বাংলাদেশীর উচিত বুকের মধ্যে এই সাকিবিয়ান এ্যাটিচিউড ধারণ করা। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে এই অপরাজেয় মনোভাব থাকাতেই প্রশিক্ষিত একটা খুনে বাহিনীর দর্প আমরা চূর্ণ করেছিলাম, আর এই মনোভাবের কারণেই আমাদের সাকিব আজ ক্রিকেটবিশ্ব শাসন করে।

আই এ্যাম প্রাউড টু বি আ সাকিবিয়ান।

আপনি??

প্রথম প্রকাশিতঃ ৭ই নভেম্বর, ২০১৪

Comments

comments