আমার খুব প্রিয় একটি জাপানী মুভি আছে- ডেথ নোট। নায়কের হাতে একটা মন্ত্রপূত নোটবই এসে পড়ে, ওই বইয়ে সে যার নাম লিখবে এবং মৃত্যুর বর্ণনা দেবে, সে ঠিক সেভাবে মারা যাবে। নোটবইটা পেয়ে নায়ক একের পর এক দুষ্ট লোকদের মেরে ফেলতে থাকে, টোকিওতে শুরু হয় শোরগোল। একটা পর্যায়ে নায়কের ভেতরে মানবীয় দোষত্রুটি ফুটে ওঠে, যে মেয়েটিকে সে ভালবাসত, তার বয়ফ্রেন্ডকে সে হত্যা করে। ঈর্ষা থেকে আরও হত্যাকাণ্ড ঘটায় সে, শহরে শুরু হয় নৈরাজ্য।
আমার জীবনে এই মুভিটার বিশাল একটা ভূমিকা আছে, বলা যায় মানব চরিত্র বিশ্লেষণে এই মুভিটি আমার চোখ খুলতে নাটকীয় ভূমিকা পালন করেছে। ছোটবেলায় হিন্দি আর হলিউড মেইনস্ট্রীম মুভিগুলো দেখে দেখে আমার ধারণা ছিল মানুষ মনে হয় শুধু দুই রকম- ভালো আর খারাপ। যে নায়ক সে সারাজীবন সব কাজ শুধু ভালোই করে যাবে, আর যে খারাপ সে আগপাশতলা হবে পাজির পা ঝাড়া।
এ্যাবসলিউটলি পার্ফেক্ট বলে আসলে এ যুগে কোন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। জীবনের শুরুতে আমি এরকম এ্যাবসলিউটলি পার্ফেক্ট মানুষদের খুঁজেছি, এবং শতকরা একশতে একশবার আঘাত পেয়েছি। একটু বয়েস হবার পর মেনে নিতে শিখলাম যে এ্যাবসলিউটলি পারফেক্ট কোন মানুষ নেই, ভুলভ্রান্তি এবং দ্বিমত নিয়েই একজনকে শ্রদ্ধা করা সম্ভব।
হুমায়ূন আজাদ স্যারকে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে মোটামুটি তিতিবিরক্ত বোধ করছি। তিনি অন্যের লেখা মেরে দিয়ে নিজের নামে চালিয়েছিলেন কিনা এটা নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি হলেও পাশাপাশি দুটো লেখা বসিয়ে সকল চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করার কাজটি কেউ করেনি।
বেনিফিট অফ ডাউট হিসেবে ধরে নিচ্ছি আজাদ স্যারের বিরূদ্ধে সব অভিযোগ সত্য, তিনি আসলেই কুম্ভীলকবৃত্তি করেছিলেন।
তাতে কি তাঁর গ্রেটনেস কমে যায়? কতটুকু কমে?
মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের মৃত্যুর চাইতেও বড় ক্ষতি আমার কাছে যেটি মনে হয় তা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হত্যা। মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, আনোয়ার পাশা, জহীর রায়হান- এঁনাদের যে ইন্টেলেকচুয়াল গ্রুপ- একটা জাতির ইতিহাসে একসাথে এতগুলো আলোকিত মানুষ আসে দু তিনশ বছরে একবার। ফ্রান্সে একবার এসেছিল রুশো, ভলতেয়ারদের সময়ে- আমরা পেয়েছিলাম ফরাসী বিপ্লব। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন, তাঁরা গোটা জাতির মেধা আর মননকে প্রভাবিত করেছিলেন- ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত একটি লড়াকু জাতিকে( আমি এখানে বঙ্গবন্ধু এবং রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকাকে খাটো করছিনা, আলোচনার সুবিধার্থে এখানে উহ্য রাখছি মাত্র)।
এই বুদ্ধিজীবীরা নিজের প্রাণের পরোয়া করেননি, পাকি মেশিনগানের বিপরীতে কলম দিয়ে লড়তে দ্বিধা করেননি একবিন্দুও। আলতাফ মাহমুদ নিজের বাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখার অপরাধে প্রাণ দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার চার দশক পরে এসে এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জায়গা দখল করে নিল বুদ্ধিবেশ্যার দল- যারা ভার্সিটিতে একটা উঁচু পদ পাবার লোভে জিহবা দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের জুতা সাফ করতে এক সেকেন্ড দেরি করেনা।
এই পা চাটা বুদ্ধিবেশ্যাদের মাঝে আজাদ স্যার ছিলেন হংসমাঝে বকযথা। মৌলবাদীদের সরাসরি আক্রমণ করতেন, কলমের নির্মম আঘাতে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতেন দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদ, অসৎ আমলা আর দুনম্বুরী সব লোকদের।
প্রিয় পাঠক, মৌলবাদের বিরোধিতা করার কারণে চাপাতির কোপ খাবার পরেও পৈত্রিক প্রাণ বাঁচাতে পিঠটান দেননি- হুমায়ূন আজাদ ছাড়া এরকম আর কতজন বুদ্ধিজীবীর নাম আপনি বলতে পারবেন বলুন দেখি?
প্ল্যাজিয়ারিজম প্ল্যাজিয়ারিজম বলে যাঁরা গেলো গেলো রব তুলছেন তাঁদেরকে একটা মজার তথ্য দেই। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের নাম শুনেছেন তো, তাইনা? ক্যালকুলাস আবিষ্কারের যে দাবি তিনি করেছিলেন, সেটা ছিলো পুরোপুরি ভূয়া, তাঁর আগেই জার্মান গণিতবিদ লিবনিজ এটি আবিষ্কার করেছিলেন। এ সংক্রান্ত যে তদন্ত কমিটি, সেটার প্রধান ছিলেন নিউটন নিজেই এবং তিনি লিবনিজকে নির্মমভাবে অপদস্ত করেছিলেন- বের করে দিয়েছিলেন সোসাইটি থেকে। ক্যানাডিয়ান গণিতবিদ জন এ্যালেনবার্গের “দি পাওয়ার অফ ম্যাথমেটিকাল থিঙ্কিং” বইটা পড়ুন, বিস্তারিত পাবেন। গুগল করে নিউটন-লিবনিজ বিতর্কও দেখে নিতে পারেন।
এই উদাহরণটা এ কারণেই দিলান, মহান ব্যক্তিদের মধ্যেও যে চরম ক্ষুদ্রতা থাকতে পারে তা যেন সাদা চোখে দেখতে পান- এ উদ্দেশ্যে।
আজাদ স্যারের প্ল্যাজিয়ারিজমের কোন অকাট্য প্রমাণ এখনও পাইনি। অমুক ইন্ডিয়ান প্রফেসর বলেছেন, তমুকে উল্লেখ করেছে- এগুলো কম্প্রিহেনসিভ প্রুফ নয়।প্রফেসর আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি, যদি সফল হই হয়তোবা কিছু নতুন তথ্য পাব।
আজাদ স্যার যদি ও কাজটি করেও থাকেন, তাতেও তাঁর গ্রেটনেস সামান্যই কমে- সমুদ্র থেকে এক বালতি পানি সরিয়ে নিলে সমুদ্রের গভীরতা যতটুকু কমে ঠিক ততটুকুই।
আজ থেকে বিশ বছর আগে এই মানুষটা কোনওরকম কপটতার ধার না ধেরে প্রকাশ্যে যেভাবে জঙ্গীবাদ-বিরোধিতা করেছিলেন, রাজনীতিবিদ-রাজাকারদের রিডিকিউল করেছিলেন, মানুষের চিন্তারাজ্যে দোলা দিয়েছিলেন- তাঁর ওই অবদানের কাছে বাকি সব অভিযোগ তুচ্ছ। এ মতের সাথে অনেকেই দ্বিমত করবেন, কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে আমি আজাদ স্যারকে এভাবেই মূল্যায়ন করি।
আজকের স্বচ্ছচিন্তার সারকথা অনেকটা এরকমঃ
একজন মানুষের পজেটিভ আর নেগেটিভ দু ধরণের অবদানকে ঠান্ডা মাথায় মাপুন। নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন, তাঁর কতটুকু নেগেটিভ সাইড আপনি মেনে নিতে রাজি আছেন। যদি দেখেন তাঁর নেগেটিভ সাইডগুলো মেনে নেবার মত, নির্দ্বিধায় শ্রদ্ধা করুন!
একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। আপনি হার্ভার্ড ভ্যালেডিক্টরিয়ান আর এমআইটি পিএইচডি হতে পারেন, আপনার চেহারা এতই সুন্দর হতে পারে যা দেখলে সমস্ত পুরুষের প্রেমযন্ত্র ঋজু হয়ে ওঠে। যে মুহূর্তে আপনি বলবেন, “ওয়াও , পাকিস্তানি প্লেয়ারস আর সো কিউট”, আপনার সমস্ত অর্জনের ক্ষ্যাতা পুড়ে আমি বলব, “এই ছাগী, ভাগ! হুশ! হুশ!”
(“ছাগী…হুশ” অংশটির কপিরাইট Anik Andalib ভাইয়ের)
প্রথম প্রকাশিত: ২৭শে জুলাই, ২০১৫