২০০৮ সালের স্প্রিং-এ আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করি। ২০০৭ থেকে ২০০৯-জীবনের এই দুবছর কেটে গিয়েছিল বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে নিতে। আমাদের সমাজের “ট্রেডিশান” অনুসারে নর্থ সাউথ বা যে কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারী চাকুরির চেষ্টা করাটা “পাপ” এর কাছাকাছি কিছু, বিশেষ করে চোখের সামনে যখন খুব বেশি নজির আমরা দেখিনা।গোলাম মওলা রনি টাইপের শাখামৃগেরা মাইক্রো লেভেলে তখনও ছিল, ঠিক এখনকার মতই। আর NSU প্রোডাক্ট এই আমার মত বেকার “ভিকটিম” পেলে এদের মোটামুটি “ফিল্ড ডে” শুরু হয়ে যেত।
আমার আগে শুনেছিলাম শাবাব ভাই নামের একজন ২৫ তম বিসিএস- এ ফরেন সার্ভিসে ছিলেন। ভাইয়ার পোস্টিং দেশের বাইরে হওয়াতে তাঁর সাথে দেখা করতে পারিনি, নিতে পারিনি কোন মূল্যবান পরামর্শ। জঙ্গল কেটে আগাতে হচ্ছিলো, দুহাত ভর্তি সাধারন জ্ঞানের বই, পড়তাম আর চোখে অন্ধকার দেখতাম। বিসিএস পরীক্ষা দিতে চাচ্ছি শুনলে নর্থ সাউথের সমসাময়িক অনেক বন্ধুবান্ধব এমনভাবে তাকাতো যেন মংগলগ্রহ থেকে এসেছি। আর পাস করে “তেমন কিছু করছিনা” দেখে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে “নিকটাত্মীয়” দের কাছ থেকে নানারকম মধুর মন্তব্য তো আছেই।
এমন একটা সমাজে আমরা বসবাস করি যেখানে আপনার দুর্দিনকে কিভাবে আরো বিষাক্ত করে তোলা যায় এটা মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কিভাবে আপনার অন্ধকার সময়টাকে প্রলম্বিত করা যায় সেটা নিয়ে পরানের একেবারে গহীন ভেতর থেকে আপনার এই আশেপাশের মানুষই চেষ্টা করবে, হুল ফোঁটাবে নিকটাত্মীয়ের দল। এই যে আমি সময়ে অসময়ে এটা-সেটা বলে আপনাদের মন খারাপ ভাব দূর করতে চেষ্টা করি- কারণটা এই আজ বললাম। বাবা মা ছাড়া আমাকে কেউ এগুলো বলেনি, মন খারাপের সময়ে মাথায় হাত বুলিয়েছে এরকম কতজন ছিলো হাতে গুনে বলে দেয়া যাবে।
আমার সেই ট্রানজিশন পিরিয়ডে যে প্রতিষ্ঠানটি পরম মমতায় আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ। আমি অর্থনীতির ছাত্র, কিন্তু সাহস করে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম ওখানকার টিচিং এ্যাসিস্টেন্টশিপের। বাঘা বাঘা স্যারদের ভেতরে ঠিক এই মুহূর্তে খলীকুজ্জামান ইলিয়াস (কে এম ই) স্যারের কথা মনে আছে- ভাইভা বোর্ডে যিনি আমাকে বলেছিলেনঃ “তুমি এক্স ক্যাডেট? তাহলে তো সেনা কায়দায় তোমাকে দিয়ে কাজ করাতে হবে। কোন কথা নাই, আগামীকাল থেকে কাজ শুরু!”
নিপাট ভদ্রলোক সেলিম সারোয়ার স্যার আর তাঁর স্ত্রী মালেকা ম্যাডাম- দুজনকেই খুব ভয় পেতাম, বিনা কারণেই। ম্যাডামের বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন, আমি পুলিশে জয়েন করেছি শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন।
খুব বেশি মনে পড়ে শাফকাত চৌধুরী স্যারকে। বাংলাদেশে যদি ৫ জন ইংরেজি জানা লোক থাকে, স্যারকে যারা চেনেন একবাক্যে বলবেন তিনি তাঁদের ভেতরে অন্যতম। জিআরই তে গণিতে ৮০০ তে ৮০০ পাওয়া অনেকের কথা আমরা জানি। শাফকাত স্যার ইংরেজিতে এই অসাধ্য সাধন করে আমেরিকায় পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন। পার্থিব খ্যাতি ও সাফল্যের প্রতি একেবারেই উদাসীন চিরকুমার এই মানুষটির কাছ থেকে ছিঁটেফোঁটাও যদি শিখতে পারতাম!
আজফার হোসেন স্যারও তখন আমাদের ওখানে পড়াতেন, সুযোগ পেলেই স্যারের ক্লাসে যেতাম সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও। একবার স্যার ক্লাসে বললেন, আচ্ছে, “ব্লু” বা নিল রঙ কিসের কথা মনে করিয়ে দেয়? সবাই যখন বিষাদ ইত্যাদির কথা বলছে, তখন আমার মুখ থেকে ফট করে বেরিয়ে গেল “ফিল্ম”। আমি আজও জানিনা এটা কিভাবে হল (আগের সপ্তাহে মাসুদ রানার থ্রিলার পড়েছিলাম, একই নামের-এটাই কি কারণ!) ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকালো, আর তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। এরকম অপ্রস্তুত জীবনে খুব বেশি হইনি!
আব্দুস সেলিম স্যার পড়াতেন ইংলিশ ১০৫, অবাক হয়ে তাঁর কথা শুনতাম (গিলতাম বললেই সঠিক হয়)। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রেজেন্টেশন কিভাবে দিতে হয় তার প্রথম অফিশিয়াল পাঠ সম্ভবত তাঁর ক্লাসেই শিখেছি, যেটা এখনও কাজে লাগে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন আরেকটা জিনিস শিখেছিলাম এই কোর্সে- এম এল এ ডকুমেন্টেশান। রেফারেন্স/বিবলিওগ্রাফি কিভাবে লিখতে হয় এটা তাঁর কাছেই শেখা।
মনে পড়ে মাহবুব ভাইকে-শ্মশ্রুমণ্ডিত, অসম্ভব ধার্মিক এই ভদ্রলোক ইংরেজী বিভাগের এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার। পাশাপাশি অবস্থিত কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের চাইনিজ অতিথিরা কর্মদক্ষতার কারণে উনাকে খুব পছন্দ করত, আর ভয়াবহ দুষ্ট আমরা এটার ভিন্নরূপ বের করে উনাকে খ্যাপাতাম (সর্বশেষ ঢাকাতে দেখা হবার পর আমিও এই কাজ করেছি)।
ফারজানা মোহসিন ম্যাম ছিলেন আমার ডায়রেক্ট সুপারভাইজর। আমি যাতে বিসিএস প্রস্তুতি ভালোভাবে নিতে পারি এজন্যে তিনি যে কতভাবে সহায়তা করেছেন বলে শেষ করা যাবেনা। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে তো এক সপ্তাহ ছুটিই দিয়ে দিলেন, বললেন , “যাও, ভালোভাবে পরীক্ষা দাও”। পরবর্তীতে রাফিয়া তাহসিন এবং মৌসুমী মিস-দুজনের কাছ থেকেই একই রকম সহযোগিতা পেয়েছি।
সহকর্মীরা আজ অনেকেই নর্থ সাউথের শিক্ষকঃ নাদিয়া তারিক এবং নওশীন সাবা সিরাজ শুনেছি ছাত্রছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। নওশীনকে আমি ডাকতাম “এ্যানিমে” বলে- সারাদিন কিচিরমিচির করে এ্যানিমে আর মাংগা নিয়ে কথা বলত। মজার ব্যাপার, জাপান এলাম আমি- আর এখানে ওগুলোর ছড়াছড়ি দেখে শুরুতেই ওর কথা মনে পড়ল। দেশে যাবার সময় বেশ কিছু নিয়ে যাব ঠিক করেছি।
যোগ ব্যায়ামের এখনকার নামকরা শিক্ষিকা আনিকা রাব্বানী-ও আমাদের সাথে ছিলো। আমি ছিলাম মিলিটারি কায়দার, সিরিয়াস টাইপের- ও পুরো উলটো। আমার এই অতিরিক্ত সিরিয়াসনেস নিয়ে কি পরিমান যে জ্বালিয়েছে আমাকে!!! খাতা দেখছি, হুট করে সবাইকে নিয়ে চিল্লাপাল্লা শুরু!!
বাবার ডিপ্লোম্যাটিক চাকুরির সুবাদে সুমিত্রা (ছদ্মনাম) গোটাপাঁচেক ভাষা জানত। একটা শিপিং কোম্পানিতে চাকুরির জন্যে সিভি বানিয়েছিল, আমি ওটাকে ছাত্রদের এসাইনমেন্ট মনে করে গ্রেডিং-ও করেছিলাম! খ্যাপাবে বলে কাউকে আর বলিনি, এই আজ স্বীকার করলাম!
এখনকার বিখ্যাত গায়িকা এলিটা আপুর “মার্চেন্ট অফ ভেনিস” নাটকটি গোটা নর্থ সাউথ জীবনে আমার সবচাইতে স্মরনীয় একটি স্মৃতি। উনিও ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। সম্ভবত রুম্মান নামে একজন হাসির অভিনয় করেছিলো ওটায়-পোর্শিয়ার(এলিটা আপু) স্বামী ব্যাসানিওর বন্ধুর চরিত্রে। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল ওর কাণ্ডকারখানা দেখে। ও এখন কোথায় আছে জানিনা, কেউ খবর পেলে ট্যাগ করে দেবেন প্লিজ!
২০১২ সালে বর্তমান পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ স্যারের সাথে ডিউটিতে গিয়েছিলাম সোনারগাঁ হোটেলে। হাতে ওয়্যারলেস, কোমরে গ্লক-১৭ পিস্তল গোঁজা- একবিন্দু ভুল করার সুযোগ নেই নিরাপত্তায়। স্যারকে নিয়ে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ দেখি চিৎকার করে কে জানি ডাকছে-” এই পিচ্চি তুই এখানে কি করিস??!!! কি সাংঘাতিক, সংগে পিস্তল ক্যান??!!!”
এলিটা আপু, তোমার অত্যাচারে আরেকটু হলে সাধের চাকুরিটা গিয়েছিল আমার!!!
আরো অনেকেই ছিলো, স্থানাভাবে তাদের কথা উল্লেখ করছিনা। তার মানে কিন্তু এই না যে আমার অনুভূতির ধার তাদের জন্যে কিছু বা কম!
সবকিছু মিলিয়ে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগ আমার স্মৃতিকোঠায় কোন রাজসিক দরবারের দেয়ালে খচিত মণিমুক্তার মতই উজ্জ্বল। হঠাৎ করে এত কথা মনে পড়ে যাওয়ার কারণ ওদের ম্যাগাজিন “English Matters”।
তাদের প্রাক্তন টিএ (টিচিং এ্যাসিস্ট্যান্ট) এর একটা ইন্টারভিউ ছাপিয়েছে ওরা। আমার পথচলার গল্পের চুম্বক কিছু অংশ ওখানে শেয়ার করেছি, আগ্রহীরা চোখ বুলাতে পারেন।
ও হ্যাঁ, শেষ করার আগে আরেকটা তথ্য দিইঃ ঝাড়া ছয়ফুটের উপর দেহ এবং বাঁজখাই গলার স্বরের কারণে পরীক্ষার হলে সবচাইতে বিশৃংখল রূমগুলোতে আমার ডাক পড়ত। ছাত্ররা আদর করে ডাকত “টেরর এ্যাসিস্টেন্ট” (টি এ)!
সবশেষে, টিচিং এ্যাসিস্টেন্টদের কমন রূমে যে কথাটি লেখা ছিল , এবং আমার চলার পথে যেটি দারুণ সাহস যুগিয়েছে সেটা সবার সাথে শেয়ার করিঃ
Life is a strange journey: in one moment you will be enjoying the sunshine, the very next moment you will be hit hard by storm to be thrown at rock bottom.
With time, everything will change: people, environment, priorities-everything. The last person on earth to let you down will probably do. So, never mind-smile a lot, take a hundred pictures a day, although the persons in the picture might change. Still,no matter what, be happy and laugh.
You know why?
Because, one single minute you remain unhappy is 60 seconds of happiness you’ll never get back.
অনেক অনেক শুভকামনা !
প্রথম প্রকাশিতঃ ১৯শে নভেম্বর, ২০১৪