কোতোয়ালের জীবনশিক্ষা-০০১

দুই হাজার বারো সাল, সারদায় ট্রেনিং শেষ করে প্রবেশন পিরিয়ড কাটাতে গিয়েছি চুয়াডাঙা জেলায়। চুয়াডাঙার ছয় মাস আমার জীবনে অমূল্য- আই লিটারালি লিভড লাইক আ প্রিন্স দেয়ার। জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা এই ছয় মাসে পেয়েছি, যার একটি আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

আমাদের দু মাস থানায় থাকা লাগে- আমি ছিলাম দামুড়হুদা থানায়। চুয়াডাঙায় দামুড়হুদা নাম শুনে যাঁরা নাক সিঁটকাচ্ছেন তাঁদের বলি, এই থানাটা আমেরিকান বা জাপানী যে কোন পুলিশ স্টেশনের চাইতে কোন অংশে কম আধুনিক ছিলোনা। ইউ এন ডি পি এর অর্থায়নে বাংলাদেশের ছয়টি অত্যাধুনিক থানার একটি ছিল এই দামুড়হুদা থানা। আমি সারা সকাল থানার কাজকর্ম দেখতাম,বিকেলে স্কুলের ছেলেপেলের সাথে ভলিবল খেলতাম, মাঝে মাঝে ফুটবল। আর রাতের বেলা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সীমান্ত অঞ্চলে বা সন্ত্রাসীর ডেরায় অভিযান।ইশ, কি প্রচণ্ড মিস করি সেই দিনগুলো!!!!

চুয়াডাঙাবাসী কেউ যদি থেকে থাকেন এখানে, জেনে রাখবেন, আমার বুকের ভেতর খুব নরম একটা জায়গা আপনাদের জন্যে বরাদ্দ।
দামুড়হুদা থানায় একটা খুব শয়তান লোক ছিলো, ড্রাগ/চুরি/ডাকাতি এমন কিছু নেই যা সে করতনা। এই ব্যাটাকে ধরার জন্যে ওয়ারেন্ট বের হল একদিন। যার নামে এটা ইস্যু হল, ওই ব্যাটা ছিল বদের হাড্ডি-মুখে জ্বি স্যার জ্বি স্যার করে ফেনা তুলে ফেলত কিন্তু কাজের বেলায় লবডঙ্কা।

ব্যাটার বয়েস চল্লিশের উপরে, আমার তখন ছাব্বিশ। আমার বাবাকে কখনো দেখিনি চাকুরিজীবনে অধীনস্থদের সাথে জোরে কথা বলতে, কাউকে “ঝাড়ি” কিভাবে দিতে হয় শিখিনি তখনো। কিন্তু বনবিভাগ আর পুলিশ বিভাগ যে এক নয়, এই কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম।

প্রতিদিন সংবাদ পাই আসামীকে অমুক জায়গায় দেখা গেছে, আর প্রতিদিন আমি ওই দুষ্ট অফিসারকে ডেকে রিকোয়েস্ট করি, “ভাই, ওয়ারেন্টটা তামিল করেন প্লিজ”।

আমার থানার ওসি ছিলেন অভিজ্ঞ মানুষ- তিনি খেয়াল করলেন ব্যাপারটা। আমাকে ডেকে বললেন, “স্যার, বেয়াদবি নেবেন না। আপনি ভদ্র মানুষ, তবে পুলিশে সব সময় ভদ্র হলে চাকুরি করতে পারবেন না”। এই বলে কানে কানে শিখিয়ে দিলেন কি করতে হবে।
পরের দিন ওই অফিসারকে ডাকলাম, পাশে ওসি সাহেব বসা। ওসি সাহেবের বডিগার্ডের কাছ থেকে গজার গাছের মোটা লাঠিটা চেয়ে নিলাম। তারপর বললাম,

শোন %ঁ&&ঁ৳%#( লেখার অযোগ্য), আজকে সন্ধ্যার মধ্যে আসামী ধরা না পারলে এই আস্তা লাঠির পুরোটা আমি সবার সামনে তোর *&#@৳( লেখার অযোগ্য) দিয়ে ভরে দেব”
সেদিন ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে আসামী হাজির।

ওসি সাহেব পাশেই ছিলেন, আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “স্যার, আপনি পুলিশিং শিখে যাচ্ছেন!!”
কাউকে গালাগালি করতে শুনে এরকম আকর্ণবিস্তৃত এবং একেবারে অন্তর থেকে কেউ এভাবে হাসতে পারে এটা ওইদিন ওসি সাহেবকে না দেখলে জানতাম না।

মরাল অফ দা স্টোরিঃ
পুলিশিং এ যা, বাস্তব জীবনেও তাই- এই দুনিয়াটা লুতুপুতু ভালমানুষদের জন্যে না।

আমি বলছিনা যে আপনি কাউকে দেখামাত্র সুয়ারেজের মত দাঁত বসিয়ে দেবেন। তবে দাঁত বসানোর সক্ষমতা যে আপনার ভালভাবেই আছে, এইটা দেখতে এবং দেখাতে ভুলবেন না।

(কোতোয়াল শব্দটার মানে সে যুগের নগররক্ষী বা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এখনো দেখবেন, মুঘল আমলের এই নাম এযুগেও কোতোয়ালী থানায় বেঁচে আছে)

প্রথম প্রকাশিত: ৮ই জুন, ২০১৫

Comments

comments