অনুগল্প‬: আংগুল

আঠাশ আগস্ট, উনিশ শ একাত্তর

“জুয়েল, একটা নাম বলো শুধু, একটা মাত্র জায়গা চিনিয়ে দাও| আই সুয়্যার অন আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ ব্যাক ইন লাহোর, ইউ উইল বি ফ্রি”

কথাগুলো বলছিলেন মেজর ফারুক আফজাল| পাকিস্তান আর্মি টিমের হয়ে ওপেনিং বল করতেন তিনি, সেই সুবাদে দুবছর আগে লাহোরে দেখা হয়েছিল জুয়েলের সাথে| ইস্ট পাকিস্তান ভার্সাস আর্মি টিমের ম্যাচে বাংগালি একটা ছেলে গুনে গুনে তিনটা ছক্কা মেরেছিল তাকে, যার শেষটা স্টেডিয়াম পেরিয়ে সৈনিক ক্যান্টিনে গিয়ে পড়েছিল|

আই বাপ, ইয়ে বংগাল কা শের কৌন হ্যায় রে! ক্রীড়াসুলভ মনোভাবের অধিকারী ফারুক নিজেই গিয়ে পরিচিত হয়েছিলেন জুয়েলের সাথে| পাকিস্তান জাতীয় দলেরও অনিয়মিত সদস্য ফারুক আফজাল নিশ্চিত জানতেন, বাংগালি হোক আর যাই হোক, এই ছেলে পাকিস্তানের হয়ে ওপেন করবেই|

নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, সেই জুয়েল আজ তার সামনে| এই শেখ মুজিব লোকটাই সব নষ্টের মূল, ইয়ং ছেলেদের মাথা খেয়ে এরকম একটা প্রতিভাকে ঠেলে দিয়েছে যুদ্ধের মুখে| গাদ্দারটাকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে ভেবে আত্মতৃপ্তিও পেলেন তিনি|

সদারসিক জুয়েলকে সহজেই সঠিক পথে আনতে পারবেন, এরকম একটা আত্মবিশ্বাস তার ছিল, কিন্তু গত তিন দিনে তা পুরোটাই উধাও হয়ে গিয়েছে| সেনাপরিবারেই জন্ম ফারুকের, বাবাও ছিলেন পাকিস্তান আর্মির কর্নেল| তাই যত পূর্ব পরিচয় থাকুক, তথ্য আদায় করতে সব রকম কায়দাই ব্যবহার করেছেন জুয়েলের উপর|

হালকা ভয় ভীতি দিয়ে শুরু হওয়া ইন্টারোগেশন তিন দিন পার হবার পর জুয়েলের রাজপুত্রের মত চেহারাটাকে মোটামুটি কসাইয়ের দোকানের থ্যাতলানো কাবাবের মাংসের রূপ দিয়ে ফেলেছে, ফারুক নিজেও তাকাতে পারছেন না| অথচ হতভাগাটা একটা শব্দ বলছেনা!

রেগে গিয়ে জুয়েলের ভাংগা আংগুল তিনটি চেপে ধরলেন তিনি, গুলি লাগা এই আংগুল তিনটি দেখেই মুক্তি হিসেবে চেনা গিয়েছিল ওকে|

“মাগো!!” আর্তনাদ করে উঠল জুয়েল|

Jewel, my friend, all these can end if you cooperate. I will arrange your medical treatment,I will see so that you can play cricket again.Dont make me do this, please!

জুয়েলের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন কথাগুলো|

কদ্দুর কি বুঝল জুয়েল তা ফারুক বুঝতে পারলেন না, তবে ওকে কথা বলার সুযোগ দিলেন|

“মেজর , আই হ্যাভ সামথিং টু শো ইউ, রিলিজ মাই হ্যান্ডস”|

সাথে সাথে হাত খুলে দেয়া হল, সামনের টেবিলে এলাকার ম্যাপটাও এগিয়ে দিলেন ফারুক| তিনি নিশ্চিত, জুয়েল এবার অন্তত একটা আস্তানা দেখিয়ে দেবে|

কিন্তু জুয়েল খুব অদ্ভুত একটা কাজ করল, যেটা তিনি কল্পনাও করেননি| বাম হাত দিয়ে ডান হাতের কনুই ধরল সে, যে হাতের আংগুল গুলো ভাংগা সেটি|

“Some decades later, these three fingers of mine will play for my country in World Cup.For now, this is for you!

চোস্ত ইংরেজিতে কথাগুলো বলে ডান হাতের ভাংগা মধ্যমাটি মেজর ফারুকের মুখের সামনে আড়াআড়িভাবে তুলে ধরল ও, শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চিৎকার করে বলল, “জয় বাংলা!”

পরমুহূর্তে সেভেন পয়েন্ট সিক্সটু এমএম চায়না পিস্তলের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল পাকিস্তানের সেরা ওপেনার শেখ হালিম চৌধুরী জুয়েলের নিথর দেহ|

তার প্রায় তিন দশক পর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে প্রথম বারের মত পাকিস্তানের মুখোমুখি হল বাংলাদেশ| দলের হয়ে ওপেনিং বল করতে রান আপ শুরু করল আজকের গতিদানব খ্যাত খালেদ মাহমুদ সুজন| কেউ খেয়াল করলনা, যে তিন আংগুল দিয়ে সুজন বলটা ধরেছে, হাতের বাকি আংগুলের চাইতে সেগুলো বেশ খানিকটা লম্বা|

এর পরেরটুকু ইতিহাস, যেটি সবারই জানা|

বাষট্টি রানে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের কাছ হেরে হাড়িচাচার মত মুখ করে স্টেজে উঠলেন ওয়াসিম আকরাম| স্পীচ দেবার ঠিক আগে ভয়াবহ আতংকে শিউরে উঠেছিলেন এক মুহূর্তের জন্য, কি দেখে, কাউকে বলেননি|

একী! গ্যালারির বিশাল স্ক্রীনে মাঠের বদলে শুধু একটা রক্তাক্ত মিডেল ফিংগার দেখাচ্ছে কেন!

প্রথম প্রকাশিতঃ ১লা মার্চ, ২০১৫

Comments

comments