ক্রিকেট নিয়ে পড়া আমার সেরা উপন্যাস কোনটি?
প্রায় আঠারো বছর আগে পড়া মতি নন্দীর “জীবন অনন্ত” – এক মিনিটও চিন্তা করতে হবেনা
এই উপন্যাসটি দুই ভারতীয় বাঙালি ক্রিকেটার জীবন আর অনন্ত-কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে| অনন্তের বাবা ছিলেন সততার সাথে আপোষ না করা একজন মানুষ, যিনি বড় পদের চাকুরি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিলেন যাতে নোংরা টাকায় ছেলেকে মানুষ করতে না হয়| ইডেন গার্ডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলারদের দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ছেলেকে ফাস্ট বোলার বানাবেন| এই স্বপ্ন সফল হবার আগেই তাঁর মৃত্যু ঘটে, আর তখন অনন্তকে নিয়ে একা লড়াই করেন মা তনিমা|
অনন্ত ধীরে ধীরে বড় হয়, অনূর্ধ্ব উনিশ দলে খেলার সুযোগ পায়| তার রূমমেট জীবন মারদাঙা ওপেনিং ব্যাটসম্যান, সবাই জানে,শিগগিরি টেস্ট দলে ডাক পাবে ও| হঠাৎ এক বাইক এ্যাক্সিডেন্টে হাত কাটা পড়ে জীবনের, চিরতরে শেষ হয়ে যায় তার টেস্ট খেলার আশা| বন্ধু অনন্তকে ঘিরেই সে তার অপ্রাপ্তি মেটানোর স্বপ্ন দেখে, হয়ে যায় তার ছায়াসঙ্গী|
পিতৃহীন অনন্তের কোন ব্যাক আপ নেই, বাঙালি বলে তাকে অবহেলা করা হয় বার বার| আমাদের কলকাতার দাদাবাবুরা যতই অস্বীকার করুক না কেন, মতি নন্দী তাঁর এই লেখায় ভারতীয় ক্রিকেট পলিটিক্সে বাঙালির অছ্যুৎ অবস্থানটা ঠিকই তুলে এনেছেন|
অস্ট্রেলিয়া ভারত সফরে এসে পেস বোলিং দিয়ে রীতিমত নাস্তানবুদ করে ভারতকে, তারপর বেরিয়ে পড়ে একের পর এক স্ক্যান্ডাল| পুরো দলটার আশি ভাগ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়, আর সেই সুবাদে ভারতের হয়ে টেস্ট খেলতে নামে অনন্ত|
শুরুর ঠিক আগে ড্রেসিং রূমে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পায় অনন্ত, কিন্তু সারাজীবনের স্বপ্ন পূরণের লোভে সেটা সে টিম ম্যানেজমেন্টকে জানায়না|
শুরুতে ব্যাটিং থাকায় ধরা পড়েনা এটা, কিন্তু ক্যাপ্টেন ঠিকই টের পেয়ে যায়|
প্রচন্ড ক্ষেপে অনন্তকে জানিয়ে দেয়া হয়, তার টেস্ট ক্যারিয়ার শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল এই মিথ্যাচারের জন্যে|
এ সময়ে অনন্তের সাথে দেখা করতে আসে জীবন|
পরের দিন দ্বাদশ ব্যক্তিকে মাঠে ঢুকতে বাধা দেয় অনন্ত, ক্যাপটেনকে আকুতি করে বলে, “স্যার, আমাকে এক ওভার বল দিন, আর চাইবনা, মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাব”
জীবন কি বলেছিল অনন্তকে? ও কি পেরেছিল নিজের হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনতে? কিভাবে?
উত্তর চাইলে পড়ুন বইটি| আমি পড়েছিলাম আনন্দমেলা পূজা সংখ্যায়,তবে আসল বইও পাওয়া যাবে নিশ্চিত, ইন্টারনেটেও পাবেন|
এই বইটি আমার কিশোর বয়েসে ক্রিকেটের প্রেমে পড়তে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে| ক্রিকেট উপন্যাসের আড়ালে এটা আসলে একজন মানুষের জীবনযুদ্ধের গল্প| বইটির সেরা অংশটুকু না বলি,তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশ অনন্তকে দেয়া ওর বাবার উপদেশ, যা এই আঠার বছর পরেও আমার লাইন বাই লাইন মনে আছে:
“অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই তুমি পাবে মাঠে| ফেদারবেড পীচ, ব্যাটিং স্বর্গ ভেন্যু তো আছেই, তোমার বলে ওঠা একেবারে লোপ্পা ক্যাচও পড়বে মাটিতে| তবুও, এসব কিছু ছাপিয়েই তোমাকে জিততে হবে| এমনভাবে নিজেকে গড়তে হবে যাতে ভাঙা পা নিয়ে বল করেও তুমি উইকেট পাও”
প্রিয় পাঠক, জীবনের লড়াইয়ে সাফল্যের অগ্নিমন্ত্রও কি এটাই নয়?
হ্যাপি রীডিং!
প্রথম প্রকাশিতঃ ১০ই মে, ২০১৫