বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম চারটি দলে বিভক্ত–
১) কুল ডুড গ্রুপ, হু ডোন্ট গিভ আ ড্যাম
২) ছাগু গ্রুপ , যারা একাত্তরকে গণ্ডগোল ভাবে
৩) ভাদা গ্রুপ, যাদের কাছে স্বাধীনতা ভারতের দান
৪) চোখ কান খোলা গ্রুপ, যারা সঠিক ইতিহাসটা বুকে ধারণ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করে|
আজকের পোস্ট ৩য় দল কে নিয়ে|
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা নিয়ে নতুন করে বলার কোন অবকাশ নেই| একাত্তরে ভারত আমাদের অস্ত্র শস্ত্র, ট্রেনিং এবং সরাসরি সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেছে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সারাবিশ্বে কূটনৈতিক লড়াই চালিয়েছেন, হাজারের উপরে ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন| এই যে কলকাতার দাদাবাবুদের কিপ্টেমি নিয়ে আমি হাসিঠাট্টা করি, ওখানকার মুচিরাও তাদের এক দিনের উপার্জন বাংলাদেশের এক কোটি শরনার্থীদের পেছনে দান করেছিল|
ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কত ভয়াবহভাবে প্রলম্বিত হত, এটা কল্পনা করতেও ভয় হয়|
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামগ্রিক স্বার্থ জড়িত ছিল, এটা মাথায় রেখেও তাদের প্রতি যথোপযুক্ত কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদর্শন করতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই| আরবের তথাকথিত মুসলিম ভাইয়েরা যখন আমাদের দেশের গণহত্যাকে স্রেফ চেপে গিয়েছে, সেখানে ভারতের এই অবদানকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকৃতি দিলে জাতি হিসেবে আমাদের ছোট হবার কোন কারণ নেই|
কিন্তু মুশকিলটা হয় তখন যখন আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতের একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা করা হয়| এই কাজটা একজন ভারতীয় বা পাকিস্তানি করলে আমি অবাক হইনা, কিন্তু আমরা নিজেরাই যখন করি, লজ্জায় মাটির ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে| ভাদা প্রজন্মের কথা বাদই দিলাম, অনেক চুল দাড়ি পাকা লোককে এসব মন্তব্য করতে দেখি|
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমলের সাবেক তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী “মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর” বইটিতে আমাদের সেনা অধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নিম্নোক্ত উক্তিটি উল্লেখ করেছেন:
“একাত্তরের ২৫ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর ভারত আমাদেরকে অস্ত্র, ট্রেনিং ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করলেও ৩রা ডিসেম্বরের আগে সরাসরি সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেনি, সশস্ত্র সংগ্রামে তাদের ভূমিকা ছিল সীমিত এবং সহায়ক হিসেবে| এই নয় মাস ঝড় ঝঞ্জা মাথায় নিয়ে সীমিত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়েছে আমাদের মুক্তিবাহিনী| কাজেই, মুক্তিবাহিনীকে ভারতের সহায়ক শক্তি হিসবে বর্ণনা করা অপমানজনকই শুধু নয়, এধরণের মন্তব্য ইতিহাস বিকৃতির সামিল|”
ভারতীয় জেনারেল জ্যাকব “সারেন্ডার এ্যাট ঢাকা” বইতে বলেছেন কিভাবে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের অন্ধ ও বধির করে ফেলেছিল, যার ফলে ১:১.৫ রেশিও নিয়েও ভারতীয় বাহিনী দ্রুত পাকবাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে| উল্লেখ্য, সামরিক নীতি অনুসারে রেশিও ১:৩ (একজন প্রতিরক্ষাকারী পাকিস্তানি সেনার বিপরীতে ৩ জন আক্রমনকারী ভারতীয় সেনা) না থাকলে এধরণের যুদ্ধে জয়লাভ দূরের কথা, অংশ নিতেও দ্বিধা করেন সমরনায়কেরা|
এই সমরনীতি উল্টে দিয়েছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, যেটা ভারত পাকিস্তান দুই ভাই মিলেমিশে অস্বীকার করে|
সামরিক নীতি অনুসারে একটি নিয়মিত বাহিনী আরেকটি নিয়মিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে, পাকিস্তানিরা তাই আত্মসমর্পন করেছিল যৌথ বাহিনীর কাছে| যৌথ বাহিনীতে মুক্তিফৌজ ও ভারতীয় বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে যিনি সিনিয়র তিনিই নেতৃত্ব দেবেন, এই নিয়মের সুবিধা নিয়ে এবং জেনারেল ওসমানীর হেলিকপ্টার আক্রান্ত হবার সুবাদে তড়িঘড়ি করে আত্মসমর্পনের দলিলে দুই পক্ষ হল পাকিস্তান আর ভারতের অফিসারগণ|
নিয়াজী নিজেই স্বীকার করেন, আরো মাসখানেক যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা তার ছিল| যেটা তিনি এবং ভারতীয়রা চেপে যান তা হচ্ছে, “সারেন্ডার নেহি কারেগা তো মুক্তিফৌজ তুম সাবকো কাটকে কুত্তাওকো খিলা দেগা” টাইপ থ্রেটগুলো, যা এই আত্মসমর্পন সম্ভব করেছিল এত দ্রুত,প্রাণ নিয়ে ফিরেছিল ৯৩০০০ পাক সেনা|
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী “এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য” বইটিতে বলেছিলেন, ” You fought two wars against Pakistan, both were zero sum games for you.In 1971, you want to break Pakistan and we want an independent country, thats it. Nothing more, nothing less”
প্রসঙ্গক্রমে একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করছি। এ বছরের শুরুর দিকে ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলাম। সেই ছুটির শেষ দিনে এক কিংবদন্তীর পূন্যস্পর্শে ধন্য হলাম| পাশের ছবিতে যাঁকে দেখছেন তিনি আর কেউ নন, ক্র্যাক প্লাটুনের কিংবদন্তী যোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, শহীদ রুমী, বদি, জুয়েল – এঁদের সহযোদ্ধা|
“ব্রেভ অফ হার্ট” বইটির রচয়িতা বিখ্যাত এই বীর যোদ্ধাকে চেনে না, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ন্যুনতম পড়াশোনা করেছে এমন কেউ আছে বলে মনে হয়না| বীর এই যোদ্ধা আমার বহুদিনের জমে থাকা একটা প্রশ্নের একেবারে কংক্রিট উত্তর দিলেন, যেটা জনস্বার্থে সবার জানা দরকার বলে আমি মনে করি|
আমার প্রশ্ন ছিল এরকম:
“স্যার, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবিস্মরনীয় অবদানের কথা আমরা কেউ অস্বীকার করিনা, কিন্তু অতি উৎসাহী কেউ যখন বলে স্বাধীনতা ভারতের দান, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?”
মৃদু হেসে হাবিবুল আলম বললেন, “আমি জানতাম, এই প্রশ্নটা প্রজন্ম আমাকে একদিন করবে, তাই এর উত্তর আমি বইয়ের প্রচ্ছদেই দিয়ে রেখেছি| বইটা বের কর, প্রচ্ছদে কি লেখা আছে পড়ো”
আমি পড়লাম:
“It is not hard to see why, in the vivid phrase of Colonel Deshpande, “the Paki morale is in their boots”. The Indians are bombarding them through loudspeakers, leaflets and radio broadcasts with a simple message: SURRENDER TO US NOW BEFORE THE MUKTI BAHINI GET TO YOU
(Henry Brandon, Correspondent, The Sunday Times, 12 Dec 1971)
এই মুক্তি বাহিনীর ভয়ে ৯৩০০০ পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকায় উপস্থিত মাত্র ৩৬০০ ভারতীয় সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল| এটা আবেগী বীরত্বের কথা নয়, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য|
আর আমাদের ভাদা প্রজন্ম শিলা কি জাওয়াণী তে ক্যাটরিনা কাঈফের সুললিত নাভীমূলের গভীরতা উপভোগ করতে করতে ভাবি, লিবারেশন? ইউ মিন দা গিফট ফ্রম ইন্ডিয়া?
আত্মপরিচয় সংকটে ভোগা আমাদের প্রজন্ম এই অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি বুকে ধরে আত্মশ্লাঘা অনুভব করুক, বিদায়ের প্রাক্কালে এটিই প্রত্যাশা করছি|
জয় বাংলা!
(বেরিয়ে আসার সময় এই বীর হঠাৎ বললেন, “কামারুজ্জামানরে যদি আইন ফাঁসি না দেয় তাহইলে আমি নিজের হাতে ওরে জবাই করব|” আমি আইনের লোক, ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম! )
সম্পাদনা: ঈষিতা আখতার