বিজ্ঞানমনষ্কতা কি? এটা কি নাস্তিকদের পৈত্রিক সম্পত্তি? সায়েন্স না পড়লে কি বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়া যাবে না? একজন আস্তিক মানুষ কি বিজ্ঞানমনষ্ক হতে পারেন না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছিলাম গুগলে। নিজের জন্য, এ প্রোফাইল অনুসরণ করা অনুসন্ধিৎসু তরুন তরুনীদের জন্যে। উত্তর পেলাম একেবারেই অপ্রত্যাশিত, অদ্ভুত এক জায়গায়।
সাদ আল দৌসারি নামের এক কুয়েতি যুবকের ব্যক্তিগত ব্লগে খুব সহজ এবং চমৎকারভাবে বিজ্ঞানমনষ্কতার ব্যাখ্যা দেয়া আছে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অংশটুকুর সাথে আমার ব্যক্তিগত মতামত মিলিয়ে আজকের স্বচ্ছচিন্তা।
মানুষ যখন আলোচনা করে, একমত হবার চাইতে দ্বিমত করতেই বেশি দেখা যায়। কেন হয় এমনটা?
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই দ্বিমতটা জন্মে সঠিকভাবে চিন্তা না করার কারণে| বেশিরভাগ দ্বিমত আসে অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিকভাবে চিন্তা করার মানসিকতা থেকে।
বিজ্ঞানমনষ্কভাবে চিন্তা করার সাথে সায়েন্স সাবজেক্টে পড়ার সম্পর্ক সামান্যই। সায়েন্সে পিএইচডি করেও আপনার চিন্তাভাবনা গরু ছাগল টাইপের হতে পারে। যেমন, এই কদিন আগেই নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী এক বৈজ্ঞানিক “মেয়েদের দ্বারা রিসার্চ হয়না, এরা ল্যাবে এসে খালি প্রফেসরের প্রেমে পড়ে আর ভুল করলে কান্নাকাটি করে” টাইপ রামছাগলীয় বক্তব্য করে চাকুরী খুইয়েছেন।
আপনি বাংলা সাহিত্য পড়েছেন বলে আপনার চিন্তাধারা বৈজ্ঞানিক হতে পারবেনা, এটা ষোল আনা মিছে কথা।আপনার চিন্তাধারায় যদি নীচের বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে, যে পেশাতেই আপনি থাকুন না কেন নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক দাবী করতে পারবেন।
নিরপেক্ষতা:
কোন বিষয়ে আপনার পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত থাকা চলবে না। যেমন:
একাত্তর সালে পাকিস্তানিদের কাজকর্মকে অন্ধভাবে ঘৃণা করাটা বিজ্ঞানমনষ্ক নয়।
আহা, ছাগুরা কি খুশিই না হল এটা শুনে! তাদের খুশিতে পানি ঢেলে বলছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকি বরাহদের অপকর্মের এত এত ডকুমেন্টেড প্রমাণ আছে যে এই বেজন্মাদের “অন্ধভাবে” ঘৃণা করার কোন প্রয়োজনই নেই। প্রাপ্ত প্রমাণগুলো দেখলে এদের অপকর্মের প্রতি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক মানের ঘৃণা এমনিতেই চলে আসবে!
প্রমান সাপেক্ষতা:
বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রমাণ ছাড়া কোন বিশ্বাসের কানাকড়ি মূল্য নেই, তা সেটা যেই বলুক না কেন।এ বড় নিষ্ঠুর রাজ্য।মহাবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং যদি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীটা হাওয়াই মেঠাই এর মত” , তাতে কিচ্ছু যায় আসে না যদি না তিনি প্রশ্নাতীত প্রমাণ দিতে না পারেন।এই প্রমাণ হতে পারে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষালব্ধ, এটা হতে পারে বিশাল আকারের স্যাম্পল সাইজ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান, হতে পারে অকাট্য কোন যুক্তি।কোন ধরণের প্রমান তা বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করবে।
নমনীয়তা:
আজ যদি কোন ব্যক্তি প্রশ্নাতীতভাবে ভগবানের অস্তিত্ব প্রমাণ করে দিতে পারেন, বলুন তো সবার আগে কারা মন্দিরে দৌড়াবে?
সত্যিকারের উন্মুক্ত মনের অধিকারী যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীরা। (আমি বিনা কারণে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে নোংরাভাবে অপমান করা আসিফ মহিউদ্দিন টাইপ কাণ্ডজ্ঞানহীন উজবুকদের কথা বাদ রেখে বলছি। এই এ্যাটেনশন হোরটি বা এর সমগোত্রীয়রা কি করবে তা আমি জানিনা)
প্রকৃত বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা প্রমাণে বিশ্বাস করে, এবং প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের মতামত পরিবর্তন করে| ধরুণ, কেউ সন্দেহাতীতভাবে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করল বিবর্তনবাদ পুরোটাই ভুল। নিজেকে যদি বিজ্ঞানমনষ্ক বলে দাবী করতে চাই, অবশ্যই এটা মেনে নিয়ে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমি এতদিন ভুল জেনেছি, ভুল বলেছি। এতে লজ্জার কিছু নেই, এটাই বিজ্ঞানমনষ্কতা| কোন কিছুই 100% সন্দেহাতীত নয়। আজ যা সত্যি ধরে নিচ্ছি , তা কাল ভুল বলে প্রমাণ হতে পারে।
তবে হ্যাঁ, হাজার বার প্রমাণ করা সত্যকে “1% সম্ভাবনা আছে ভুল হবার তাই এটা মানিনা” বলে উড়িয়ে দেয়াটাও কিন্তু ছাগলামি।
পদ্ধতিগত ধাপ অনুসরণ: বিজ্ঞানমনষ্ক মন হুট করে একটা কিছু চিন্তা করেই উপসংহার টেনে বসেনা। কোন বিষয়ে উপসংহার টানার আগে সেটা পরীক্ষা নিরীক্ষা, গবেষণা, নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ এবং সঠিকভাবে ফলাফল প্রদর্শনের মাধ্যমেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এই সিদ্ধান্ত বদলায় শুধু সমমানের উপযুক্ত প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে, কোথায় কি লেখা আছে তার উপরে নয়। আধুনিক বিজ্ঞান যেখানে বলছে সমকামিতা কোন রোগ নয়, সেখানে প্রবীর ঘোষের মত যুক্তিবাদী লোক (“অলৌকিক নয়, লৌকিক” নামের অসাধারণ বইটির লেখক) যখন এটাকে মানসিক রোগ বলে ফতোয়া দেন- তখন নাস্তিক, যুক্তিবাদী হয়েও তিনি পরিচয় দেন মানসিক অন্ধত্বের।
সুনির্দিষ্টতা:
অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা বুলি বিজ্ঞানমনষ্কতা নয়। ভক্তিতে গদগদ হওয়া আপনার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হতে পারে, কিন্তু তা ওই বিশ্বাসের প্রমাণ নয়। প্রার্থনায় ক্যান্সার রোগ সারে- এই দাবী প্রমাণ করতে আপনাকে দুটো গ্রুপ নিতে হবে, এক গ্রুপে থাকবে প্রার্থনা করে এমন ক্যান্সার রোগী, আরেক গ্রুপে যারা করেনা এমন রোগী| এদের ক্যান্সার স্টেজ, বয়স ইত্যাদি সমান পর্যায়ের হতে হবে।তারপর সুনির্দিষ্ট সময় ধরে এদের পর্যবেক্ষণ করে যদি দেখেন যারা প্রার্থনা করে তাদের রোগ সেরে যাচ্ছে, তবেই আপনার দাবী সত্য হবে। আপনার এই পরীক্ষা দুনিয়ার যেখানেই করা হোক, একই ফলাফল আসতে হবে।
বিজ্ঞানে আবেগঘন বোকা বোকা অস্পষ্ট ধারণার কোন স্থান নেই।
উপরের বৈশিষ্ট্যগুলো যদি আপনার চিন্তাধারায় থাকে, তাহলে আপনি নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক বলতে পারেন। একজন আস্তিক মানুষও বিজ্ঞানমনষ্ক হতে পারেন, যদি তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাসকে একান্তভাবে নিজের ব্যক্তিগত, স্পিরিচুয়াল বিশ্বাস হিসেবে রেখে তার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক তথ্যকে না মাপেন।অপরদিকে একজন নাস্তিক যখন প্রমাণ পেলেও কোন পরীক্ষালব্ধ তথ্যকে অস্বীকার করে, তার আচরণ হয়ে যায় গর্দভসুলভ।
আজকের স্বচ্ছচিন্তা শেষ করছি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা দিয়ে:
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিস্কার করে।
(মিলিত মৃত্য)
পরিশিষ্ট:
এক) এ লেখাটি ঈদ উপলক্ষে এ প্রোফাইলের সবার প্রতি আমার ক্ষুদ্র শুভেচ্ছাস্বরূপ। অগ্রজ অনীক আন্দালিব ভাইয়ের একটা উদাহরণ এ লেখায় ব্যবহার করেছি| তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
দুই) ধর্মান্ধ মূর্খরা আমাকে নাস্তিক ট্যাগ আগেই দিয়েছে, এসবে তাই আর পাত্তা দিইনা| আল্লাহ পাক আমাকে মস্তিষ্ক দিয়েছেন, দিয়েছেন চিন্তা করার ক্ষমতা। আমার ভুলত্রুটি হলে তিনি ক্ষমা করবেন, এ আস্থা আমার আছে। আল্লাহ ছাড়া আমি কাউকে ভয় করিনা, ছাগুদের চাপাতিকেও না।