দুহাজার সাত সাল। নর্থ সাউথের পুরোন ক্যাম্পাসে একটা দোকান ছিলো , ওয়েস্টার্ন গ্রিল। ওটার দোতলায় জানুয়ারির কনকনে শীতে পাশাপাশি বসে আছে শাড়িপড়া এক তরুনী আর লম্বা এক তরুণ। তরুণ নর্থ সাউথের ছাত্র, তরুনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
তরুনীটিকে ঠিক বাঙালিদের মত লাগেনা- ছিপছিপে লম্বা দেহ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গাত্র- প্রায় পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুল। হাতের আঙুলগুলো কেমন জানি আঙুরলতার মত, ছোঁয়া যায়না এমন একটা কমনীয়তা রয়েছে। স্প্যানিশ বা মেক্সিকান ললনাদের ভেতরে যে বুনো সৌন্দর্য আছে, তার ছাপ সুগভীর। জন্ম ইউরোপে, প্রাথমিক বেড়ে ওঠাও ওখানে- তারই ছাপ থেকে থাকবে হয়তবা!
তরুনীটির মন প্রচন্ড খারাপ- তার প্রিয় মানুষটি ধোঁকা দিয়েছে খুব বিশ্রীভাবে।
গল্পের তরুণটির সাথে তার পরিচয় সে সময়ের “শোনপাপড়ি” নামের একটা বাংলা সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে। পরিচয় থেকে ভালো লাগা, বন্ধুত্ব। তবে তীব্র আবেগটুকু পুরোটাই একপেশে, এবং যথারীতি ছেলেটার পক্ষ থেকে।
প্রপোজ করার সাহস ছেলেটির ছিলোনা, না করে দিলে বন্ধুত্বটুকুও হারাতে হবে এই ভয়ে। মেয়েটি একদিন জানালো, তার ভালো লাগে একজনকে। ওই একজন সম্পর্কে খানিকটা খোঁজ খবর করে ছেলেটি সাবধান করেছিলো মেয়েটিকে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সাবধানতায় কাজ হয়না।হয়ও নি।
ভগ্ন হৃদয়ে মেয়েটি সান্তনা খুঁজতে এল সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর ছেলেটির কাছে- আর ছেলেটি বুকচাপা কষ্ট সহ্য করে দেখা করতে এল।
মেয়েটি বলে গেল সবকিছু, অন্যের সাথে তার ঘনিষ্ট মুহূর্তগুলোর কথা,তারপর হৃদয়ভঙ্গের কথা। ছেলেটি চুপচাপ শুনেছিল, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি নিজ হৃদয়ের অসহ্য রক্তক্ষরণের কথা।
শুনতে শুনতে একটা পর্যায়ে ছেলেটির কানে কিচ্ছু ঢুকছিলোনা- অপলক দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে ছিল মেয়েটির চোখের দিকে- পুরো বর্ষাকালের দীঘির মত গভীর!
মেয়েটি কথা বলছে, আর ছেলেটি তার পেলব ঠোঁটের দিয়ে তাকিয়ে আছে- শব্দ কিচ্ছু কানে যাচ্ছেনা, শুধু ঠোঁটের আনুবীক্ষণিক চলাফেরা!
এরকম মহাকাল জুড়ে চলতে পারত, ছেলেটির ঘোর ভাঙলো মেয়েটির ডাকে।
মেয়েটি একটি গান দিয়েছিল ছেলেটিকে শুনতে- ছেলেটি শুধু সেই গানটি প্রতিদিন লক্ষবার করে শুনত। জগজিৎ সিং-এর “সারাখতি যায়ে, রুখসে, নাকাব, আহিস্তা আহিস্তা…”
একটা গান শুনবি? বলেই গানটা এমপিথ্রি প্লেয়ারে চালিয়ে দিলো ও।
গানটার ভেতরে অদ্ভুত একটা জাদু ছিলো, পাশাপাশি বসেও লক্ষযোজনের দূরত্বটুকু মিটিয়ে দিলো গজলের অপূর্ব সুর।
মেয়েটির প্রথম নয়, তবে ছেলেটির প্রথম। মনের ভেতরে চেপে রাখা হাহাকার আর ভালোবাসা মেশানো সবটুকু তীব্রতা মিশিয়ে ছেলেটির অনভিজ্ঞ ঠোঁট স্পর্শ করল চোখ বুঁজে থাকা মেয়েটির প্রতীক্ষিত ঠোঁটদুটোকে। প্রথমে ওষ্ঠ , তারপর অধর- এরপর দুটো একত্রে।
কয়েক সেকেন্ড, মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড- But for those briefest of moments, she belonged to him.
এরপর বহুদিন কেটে গিয়েছে, ফুজিয়ামা পর্বতের উপর জমে থাকা বরফ বহুবার গ্রীষ্মের তাপে নেমে এসেছে তরল হয়ে। একই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়েও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে যোজন যোজন অমোচনীয় দূরত্ব।
তবুও, জীবনযুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ করে ছেলেটির মনে পড়ে প্রথম চুম্বনের সেই অবিস্মরনীয় স্মৃতি।
দাঁতে ছোট্ট একটা ঘষা লেগেছিলো- ঠোঁটে লেগে গিয়েছিল ঘন বাদামী রঙের লিপস্টিকের রঙ, এরকম ছোট্ট ছোট্ট মাইক্রোসেকেন্ডের অনুভূতিগুলো কিভাবে জানি স্থায়ীভাবে বসে গিয়েছে ছেলেটির স্মৃতিতে।শতচেষ্টাতেও যে স্মৃতিগুলো কখনো মুছে ফেলা যাবেনা।
সত্যি বলতে কি, ছেলেটা মুছতে চায়ও না।
যখনই মনে পড়ে, মুচকি হাসি ফুটে ওঠে ছেলেটির ঠোঁটের ফাঁকে। আস্তে করে হাত বুলিয়ে নেয় নিজের ঠোঁটে, তারপর ঠোঁট স্পর্শ করা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
ভালবাসার লড়াই জেতেনি ছেলেটি, মুখ থুবড়ে পড়েছে কঠোর বাস্তবতা আর সমাজের দ্বৈত নাগপাশের কাছে।
কিন্তু একটা জায়গায় ও স্রষ্টা বাদে আর সবাইকে হারিয়ে দিয়েছে।
বুকের ভেতরে জমে থাকা মাইক্রসেকেন্ডের স্মৃতিগুলো ছিনিয়ে নেবে, এমন সাধ্য কি আছে কারও?
আহ, প্রথম চুম্বন!!!
পরিশিষ্টঃ
১) সেই দিনের একটা ছোট্ট স্যুভেনির ছেলেটি সযতনে সংরক্ষণ করে রেখেছে আজও।দু গ্লাস কোকের ষাট টাকা বিলের কাগুজে রিসিট-টি।
২) এ গল্পের পাত্র-পাত্রীকে আপনাদের কারো কারো পরিচিত লাগতে পারে, হেসে উড়িয়ে দিন!
৩) উপলব্ধিঃ এখন সময় ভিন্ন, বাস্তবতাও ভিন্ন- কিন্তু সেই সময়ের অনুভূতির তীব্রতাটুকু মিথ্যা না, যে আবেগ দিয়ে লিখেছি সেটাও মিথ্যা না। এই সত্যটা সবাই বুঝবে এই আশা করাটা আমার ভুল ছিলো।
৪) যাঁদের কমেন্টে কষ্ট পেয়েছি তাঁদের উপর আসলে রাগ করে লাভ নেই। সব অনুভূতির তীব্রতা অনুভব করার সৌভাগ্য বা সুযোগ তো সবার হয়না- রাগ করে কি লাভ!