লন্ডনের ঝকমকে রোদ থেকে অক্সফোর্ড এলে প্রথম প্রথম মনে হবে টাইম মেশিনে করে মধ্যযুগে চলে এসেছি। পুরো শহরটাই পড়াশোনার শহর, এর পথে ঘাটে মাঠে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার নিদর্শন। প্রথম ছবিতে প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে যে সবুজ লনের বিস্তৃত এলাকা দেখছেন এটা আসলে অক্সফোর্ডের অসংখ্য কলেজগুলোর একটি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই কলেজের মাঠে ছাত্রছাত্রীরা রোদ পোহায়, বই নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে, প্রেয়সীর কোলে মাথা রেখে বিশ্রাম নেয়, চুমু খায়। ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে চুম্বন অশ্লীল নয়, বরং শব্দের যেখানে শেষ, নি:শব্দ চুম্বনে সেখানে ভাললাগার বহি:প্রকাশের একমাত্র ভাষা। স্বত:স্ফূর্ত ও সাবলীল!
জীবতত্ব যাদুঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম ব্ল্যাকওয়েল বুক শপে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, বিশাল এই বইয়ের দোকানে বড় বড় করে লেখা:
A good book keeps you fascinated for days, a good bookshop does that for life!
অতীব সত্য কথা। তবে ওখানে যে ব্যাপারটি আমাকে বিমোহিত করেছিল সেটি শুধু মারে না, পোড়ায়ও।
ফিলোসফি সেকশনে কুযুক্তির উপর লেখা একটা বই দেখছিলাম। হঠাৎ কিন্নরীকণ্ঠে পেছন থেকে ডাক, “Excuse me,Sir, is your wifi working here??”
পেছনে তাকাতেই দেখি এক অপ্সরী, সোজা স্বর্গ থেকে নেমে ব্ল্যাকওয়েল বুক শপে ঢুকেছে।
মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চেপে গেল। বললাম, Well, I happen to be single so no wifi here (ওর উচ্চারণে ওয়াইফাই কে ওয়াইফি শোনাচ্ছিল)।
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাত বাড়িয়ে বলল, You are an extremely funny man, Sir! I am Emily Kilburn.
এমিলি কিলবার্ণ যার নাম, সে শুধু সংহারই করেনা, পোড়ায়ও! রূপ আর গুণ, কোনটা দিয়ে মারে আর কোনটা দিয়ে পোড়ায় তা আজও অমীমাংসিত। মীমাংসা এটুকুই, পরিত্রাণ অসম্ভব।
আমিও বই পড়ি দেখে জানতে চাইল, ভারতীয় দর্শনের কোন বইটা সাজেস্ট করব। বললাম, চাণক্যের নীতিশাস্ত্র আর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। চাণক্য, কৌটিল্য আর বিষ্ণুগুপ্ত যে একই লোক এটা জানাতেই চোখ টিপে বলল, জানে।
একটু অবাক হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কিভাবে?
“পড়েছি”
এবার আমি হালকা ভাব নিয়ে বললাম, তা কোথায় পড়া হয়?
“এখানেই”
-“এখানে কোথায়? আন্ডারগ্র্যাড কোন ইয়ার?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম।
” পিএইচ ডি, ফিলোসফি , অক্সফোর্ডেই, আর দুমাস বাকি”
অক্সফোর্ডের আবুল আমি এর আগে কোন অক্সফোর্ড পিএইচডি দেখিনি। ওর উত্তর শুনে আক্ষরিক অর্থেই চোখ কপালে উঠল। এই মহীয়সী রমনীর সাথে “লাইন” দিচ্ছিলাম এতক্ষণ! কি ভয়ঙ্কর!
বলল, শ্রী অরবিন্দের দর্শনের উপর পিএইচডি করছে। কনফুসিয়াসের দর্শনের প্রায়োগিক দিক নিয়ে কত শত বই, ওকে বললাম, শ্রী অরবিন্দকে নিয়েও এরকম কিছু লিখতে।
“লিখব, কথা দিলাম” বলে মৃদু হেসে চলে গেল এমিলি সংহার-দহন, আর তার পথপানে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রইলাম আমি।
ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা ঢুকলাম শেলডনিয়ান থিয়েটারে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের গ্র্যাজুয়েশন সিরিমনি হয়। চিলেকোঠার জানালা থেকে পুরো অক্সফোর্ড দেখা যায়।শহরের যে ছবিগুলো দেখছেন, ওখান থেকে তোলা।
বেরুবার সময় কি এক ঝোঁক চাপল, রিসিপশনিস্টকে বললাম- এর পরের বার টিকেট কেটে ঢুকতে হবেনা আমার, দেখে নিও।
এ জায়গার আবহাওয়াই এমন, বামনকেও চাঁদে হাত দেবার সাহস যোগায়।
Some goals are so worthy, its glorious even to fail.
ভারতীয় বীর মনোজ পান্ডের ডায়েরিতে লেখা লাইনটি বেজে উঠল মাথায়।
জয়তু অক্সফোর্ড!