সনাতন ধর্মের সাথে আমার পরিচয় খুব ছোটবেলায়, চার বছর বয়েসে। আমাদের ষোলশহর ফরেস্ট কোয়ার্টারে পাশের বাসাতেই মনোজ আঙ্কেল থাকতেন, তাঁর ছেলে মম ছিল আমার প্রাণের বন্ধু। ওদের বাসায় একটা পূজার রুম ছিল, ওটাতে মাঝে মাঝে খেলতে যেতাম। খেলা শেষে দেবীর ছবিতে মাথা ছুঁইয়ে আসত মম, পূজার ঘরে খেলা করায় দেবী যেন রুষ্ট না হন সম্ভবত সে কারণে। দেবী রুষ্ট হননি, আমি আর মম খুব ভালই আছি। আন্টি পাঁচফোড়ন দিয়ে সব্জি রাঁধতেন, আহ! অমৃত!
ছয় বছর বয়েসে বাবা কিনে দিলেন চিলড্রেন এপিকস নামে একটা বই, রামায়ণ মহাভারত দুটোই ছিল সে বইটায়। আলাদা করে কেটে পড়তাম রামায়ন, মহাভারত, ইলিয়াড আর ওডেসি। যে ঘরে বইগুলো রাখতাম সে ঘরেই আমাকে পবিত্র কুরআন শরীফ পড়াতে আসতেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। বান্দরবানের মত দূরবর্তী অঞ্চলের একজন ইমামের চিন্তার যে স্বচ্ছতা ছিল, আজ বহু পিএইচডি ধারীর তা নেই। একই রুমে তিনি একদিন আমার হাতে মহাভারত দেখেন। আমি ভেবেছিলাম বকা দেবেন, কিন্তু না! “বাবা, হিন্দু মুসলমান সবাই আল্লাহর সৃষ্টি, বিনা কারণে কারো মনে কখনো আঘাত দিওনা”- হুজুরের এই শিক্ষা আজও ভুলিনি। সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ২০০৪ সালে, পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম। জানিনা, কেমন আছেন তিনি!
ছেলেবেলায় মহাভারতের নেশায় বুঁদ হয়েছিলাম, সেই নেশা আজও কাটেনি। নিজের জীবনে দুর্যোধন, দু:শাসন আর শকুনিদের সাথে নিয়মিতই লড়তে হয় কিনা!
বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপক্ষতা কথাটি ছিল, অবৈধ সামরিক শাসক এসে মুছে দিল সেটি, বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বংশবিস্তার করল সাম্প্রদায়িক বরাহশাবকের দল। যে বাংলায় হাজার হাজার বছর ধরে সর্বধর্মের মানুষ পাশাপাশি অবস্থান করেছে, সেই বাংলায় মগজ ধোলাই করে জন্ম দেয়া হল সহিংশ শ্বাপদকূলের।
তাই গায়ের জোরে মন্দিরের ঠিক বাইরে গরু জবাইয়ের দৃশ্য আজকাল দেখা লাগে আমাদের।
আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে, বাবা মা প্র্যাকটিসিং মুসলিম। একজন মুসলিম হয়ে লজ্জার সাথে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, “সংখ্যালঘু” নামের নোংরা শব্দটি দিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা শোষণ করে চলেছি সনাতন সহ অন্য ধর্মালম্বীদের।
মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বুকে লালন করা এক বাঙালি হিসেবে আমি এর সমূল উৎপাটন চাই। মাস্টারদা সূর্যসেন আর জগৎজ্যেতি দাশের রক্তে পূন্যস্নাত বঙ্গভূমিতে প্রাণ থাকতে সাম্প্রদায়িকতাকে শেকড় গড়তে দেয়া যাবেনা।
যদি আমার এলাকায় কোন মন্দির থাকে এবং পূজার সময় কোন বদমায়েশ সেখানে ঘৃণার বীজ ছড়াতে চায়, পাঁঠার বদলে ওই বদমায়েশটাকে কিছুক্ষণ হাড়িকাঠে গলা ঢুকিয়ে রাখার ইচ্ছে আছে। বেশি না, আমার ধারণা মিনিট পাঁচেকে সব বদমাইশী দূর হয়ে যাবে।
শারদীয় আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত হোক।
সবাইকে পূজার শুভেচ্ছা!
ফিচার’ড ছবিঃ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মডেল ইশরাত সেজেছেন দেবীর সাজে, অসাম্প্রদায়িক বাংলার চমৎকার একটি উদাহরণ এটি।