জীবনের সব লড়াই যখন অর্থহীন মনে হয়, প্রিয় সবকিছুকে নির্মম কৌতুক এর মত লাগে, তখন আপনি কি করেন?
প্রশ্নটা করেছিলাম তের ঘন্টা আগে,খুব অদ্ভুত একটা জায়গায় উত্তরটা পেলাম।
মাগা জিম, রোপ্পোঙ্গি, টোকিও। ক্রাভ মাগা ক্লাস, লেভেল-1।
ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের আবিষ্কার এই সেল্ফ ডিফেন্স সিস্টেমটি গড়ে উঠেছে স্ট্রিট ফাইট ফিলোসফির উপর ভিত্তি করে। কোন নিয়ম কানুন নেই, ন্যায় নীতির বালাই নেই, রিচুয়ালস নেই, রিঙ নেই, উদ্ভট কাপড়চোপড় নেই। আপনি সাইজে আপনার প্রতিপক্ষের সমান নাকি অর্ধেক, পুরুষ না নারী, একা না সঙ্গী সাথে, দাঁড়িয়ে আছেন না মাটিতে পড়ে গিয়েছেন, ক্রাভ মাগায় এসবের কোন স্থান নেই। আপনি আক্রান্ত হয়েছেন, নিরাপদে বাড়ি ফিরতে হবে- এই হচ্ছে মূলমন্ত্র।
অন্যান্য সিস্টেমে যেসব জায়গায় আঘাত করা হারাম, ক্রাভ মাগায় শেখায় কিভাবে ঠিক ওই জায়গায় আঘাত হানতে হবে: চোখ, কণ্ঠা আর অণ্ডকোষ। মানব শরীরের এ তিনটি জায়গা সবচেয়ে দুর্বল, আর এখানে আঘাত করতে শেখাই একজন ক্রাভিস্টের লক্ষ্য।
এক ঘন্টার ক্লাস, নিজের ভেতরের হতাশাকে জলাঞ্জলি দিতে তেতে উঠেছিলাম প্রচন্ড। বিগিনিং ওয়ার্কআউট থেকে বস্তায় পাঞ্চ এবং কিক- ভীষণ আক্রোশে ফুঁসে ফুঁসে আঘাত করছিলাম। প্রতিটা আঘাতের সাথে হতাশার দানব যেন একটু একটু সরে যাচ্ছিল।
ঠিক পঁচিশ মিনিটের মাথায় লড়তে এল “স্টিভ”(ছদ্মনাম)। ঝাড়া ছয়ফুট উঁচু, বিদ্যুতের মত ক্ষিপ্র। আমার ভেতরের হতাশাটুকু যেন পড়তে পারছিল ও, আর সেটাকে নিয়ে খেলছিল। আড়াই মিনিটের বাউটে বুকে প্রচন্ড জোরে ফ্রন্ট পাঞ্চ, বাম গালে এলবো স্ট্রাইক আর তলপেটে নী স্ট্রাইক খেয়ে যখন ভূপতিত হলাম, ক্লাসের তখনও আধা ঘন্টা বাকি।
ধরাধরি করে রেস্টরূমে নেয়া হল আমাকে, হড়হড় করে বমি করলাম। মনে হচ্ছিল মারাই যাব, হেঁটে বাসায় যাওয়া সম্ভব হবেনা। উপরে জিম ম্যানেজারের মাথা দেখতে পেলাম- Go home today, big guy! Its not your day!
কি এক অদ্ভুত আক্রোশের ভূত মাথায় চাপল তক্ষুনি। বাঁচি কি মরি পরোয়া করিনা, আমাকে লড়তে হবে, ষাট মিনিটের ট্রেনিং শেষ করতে হবে।
উঠে দাঁড়ালাম, সোজা ক্লাসে গিয়ে ঢুকলাম। পনের মিনিট কেটে গেল নির্মম এক্সারসাইজ “গ্রাউন্ড ফাইটিং” এ। মাটিতে পড়ে যাবার পরেও কিভাবে প্রতিপক্ষের চোয়াল বরাবর লাত্থি কষাতে হয়, শুয়ে থেকেও কিভাবে একের পর এক ঘুঁষি ছুঁড়তে হয় তার ট্রেনিং।
শেষ পাঁচ মিনিট ফাইটিং বাউট, প্রতিপক্ষ আবারও স্টিভ। যেহেতু সুযোগ থাকা সত্বেও বিশ্রাম না নিয়ে লড়তে এসেছি, বিন্দুমাত্র ছাড় নেই।
স্টিভ এবার শুরু করল ওর ক্লাসিক হ্যামার ফিস্ট দিয়ে, সাদা বাংলায় যাকে বলে কিল মারা (ছবিতে দেখুন)। এর পর একে একে সাপের ছোঁবলের মত জ্যাব, নাইফ হ্যান্ড চপ ( হাতটাকে ছুরির মত করে কোপ মারা) , ফ্রন্ট পাঞ্চ, হুক, তারপর এক লাত্থিতে লেপ্টে গেলাম দেয়ালের সাথে।
চায়নিজ দার্শনিক সান জু এর আড়াই হাজার বছর আগের ক্লাসিক The Art Of War আমি প্রতিদিন পাঁচ দশ মিনিট পড়ি, আমার সবচেয়ে প্রিয় বই ওটা। প্রথম চ্যাপ্টারের আঠারো নম্বর সূত্রে বলা আছে, War is all about deception(তখন চ্যাপ্টার আর সূত্র নম্বর মনে ছিলনা, বাসায় এসে মিলিয়েছি)
দেয়ালে সেঁটে যাবার পর দেখলাম, স্টিভ মুখের বামপাশে গার্ড সরিয়ে নিয়েছে!
এই সুযোগ! পড়ে যাবার ভান করতে করতে দেয়াল ধরলাম, তারপর এক ঝটকায় সামলে নিয়ে ওর চোয়াল বরাবর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ক্রস বডি পাঞ্চ।
স্টিভ এতটাই চমকে গিয়েছিল যে কি করবে বুঝতে পারছিলনা। এদিকে আমার তখন রোখ চেপে গিয়েছে, অল্প যে কটা মুভ শিখেছি সব কটা ঝাড়ছি ওর উপর।
দেয়ালের এ প্রান্ত থেকে ঠেলে ধাক্কিয়ে অপর প্রান্তের কাছাকাছি নিয়ে বুক বরাবর হিল কিক , এ্যান্ড দ্যাট নকড আউট দা লিজেন্ডারি স্টিভ।
আরও পনের মিনিট পর শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে যখন বেরুচ্ছি, লিফটের নীচে দেখি স্টিভ দাঁড়িয়ে, হাতে দুটো “কিরিন” বিয়ারের তুষার শীতল ক্যান। একটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, Start, Bro! The lunch is on me!
আজকের ঘটনা আমাকে এটাই শেখাল, জীবনের সব লড়াই যখন অর্থহীন লাগে- তখন আসলে প্রচন্ড আক্রোশে ওই অর্থহীন লড়াইটাই করতে হয়।
এই সিম্পল জিনিসটা বুঝতে এতগুলো মার খেতে হল আমার:
লড়াই না করলে লড়াইয়ের মানে বুঝব কিভাবে!
Whatever your fight is, keep fighting!