খুব সেনসিটিভ একটা কেসের তদন্তে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ডাক্তার ভদ্রমহিলা পূর্বপরিচিত, আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন।হঠাৎ দেখলাম তিনি উচ্চকণ্ঠে ভেতরের একজনকে বকাবকি করছেন। কৌতুহলী হয়ে ভেতরে ঢুকলাম,দেখি সতের আঠারো বছরের একটি মেয়ে অঝোরে কাঁদছে, পাশে বসে আছে বছর চল্লিশেকের এক ষণ্ডামার্কা ভদ্রলোক।ডাক্তার ভদ্রমহিলা বললেন, “ভাই,এই বদমায়েশগুলোকে এরেস্ট করতে পারেন না?”
কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করে যা জানতে পারলাম, মেয়েটির বিয়ে হয়েছে খুব অল্প বয়েসে। বর ওই ষন্ডামার্কা ভদ্রলোকটি, বেশ আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন। তার পূর্বের স্ত্রী মারা যাবার পরে এই মেয়েটিকে সে বিয়ে করেছে, আর বিয়ের দিন থেকেই নিজের স্বামীত্ব বজায় রাখতে মেয়েটির উপর চলেছে জোরপূর্বক ধর্ষণ। বাসর ঘর হয় মেয়েটির নিজের বাসায়, পাশের ঘরেই বাবা মা ভাই থাকে। মেয়েটির ভয়াবহ চিৎকারে সবাই ছুটে এলে লোকটি হুমকি দেয়, “আমার হক আদায় করতে না দিলে বিয়া করছি ক্যান? নগদে তালাক দিয়া দিমু কইলাম”!
এরকম চলেছে প্রায় বছরখানেক, মেয়েটি সাইকোলজিকালি পুরোপুরি প্যারানয়েড হয়ে গিয়েছে। এখন আর চিৎকারও করেনা- প্রচন্ড আতঙ্কে সর্বশেষ যেটি হয়েছে, স্বামীদেবতাটি চড়াও হলেই সে অজ্ঞানমত হয়ে যায়।
“মরার মত পইড়া থাকে-এর লগে কি সংসার করুম?”- আবারও ডিভোর্সের হুমকি এবং অতঃপর চিকিৎসা করাতে ডাক্তারের কাছে আসা।
ইচ্ছে থাকলেও এ্যারেস্ট করতে পারিনি তিনটা কারণেঃ ১) স্ত্রী নাবালিকা না হলে ম্যারিটাল রেইপের কোন শাস্তি আমাদের আইনে নেই ২) ঘটনাটি আমার জুরিসডিকশনের বাইরে এবং ৩) স্বামীকে এরেস্ট করলে মেয়েটির “সংসার” ভেঙে যাবে।
“রেইপ ১০১” নামে একটা ইনফোগ্রাফ করেছি, সেখানে অতি সহজভাবে রেইপের সংজ্ঞা দেয়া আছেঃ
Any sexual intercourse without CONSENT is rape.
খেয়াল করুন, এখানে কনসেন্ট বা পারস্পরিক সম্মতির কথা বলা হয়েছে।সজ্ঞানে এবং পারস্পরিক সম্মতিবিহীন যৌনসম্পর্ক মানেই রেইপ- এটা মোটামুটি সহজে বোঝার জন্যে সংজ্ঞা।দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজও এই সহজ সংজ্ঞাটি বোঝেন না।
আমরা বাঙালি পুরুষেরা জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাই অবদমিত যৌনফ্যান্টাসিকে ঘিরে। আমাদের এডুকেশন সিস্টেমে সুস্থ ও স্বাভাবিক যৌনশিক্ষা কাকে বলে এর কোন স্থান নেই। ফলশ্রুতিতে, যৌনতার মত অতি প্রয়োজনীয়, স্বাভাবিক এবং মনোরম বিষয়টিকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা নেগেটিভ কন্ডিশনিং থেকে আমরা মুক্ত নই। এর একটা ফলাফল হচ্ছে “বাংলাদেশী সিনড্রোম” নামের মানসিক রোগ(গুগল করুন)। কোনরকম শারীরিক সমস্যা না থাকার ফলেও প্রচুর বাংলাদেশী নাগরিক সারাজীবনের এই ভুলভাল যৌনজ্ঞান প্রয়োগ করতে যায় নববিবাহিতা স্ত্রীর উপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফলাফল হয় ভয়াবহঃ ক)মানসিক কারণে স্বামীটির যৌন অক্ষমতা এবং/অথবা খ) সক্ষমতা প্রকাশ করতে গিয়ে মেয়েটির উপর ম্যারিটাল রেইপ।
খেয়াল করুন, আপনার স্ত্রীর স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে এবং সম্মতিতে যদি আপনি যৌনসংসর্গ না করেন, আপনি ধর্ষণ করছেন।স্বামী হয়েছেন মানেই ইচ্ছেমত চড়াও হবার অধিকার আপনি রাখেন না।
আমাদের সমাজের খুব বড় ফ্যান আমি নই, যত দেখছি অভক্তিটা ক্রমশঃ বাড়ছে। জীবনে বহুবার ভয়াবহ সব বিপদে পড়েছি, সেসব বিপদ থেকে কিন্তু সমাজ আমাকে উদ্ধার করেনি- বরং আড়ালে এবং প্রকাশ্যে টিটকিরি দিয়ে কিভাবে পরিস্থিতি আরো খারাপ করা যায় সে চেষ্টা করেছে।সুতরাং, সমাজ কি বলবে সেই দোহাই দিয়ে যখন কোন বাবা মা দিনের পর দিন তাদের আদরের মেয়েটিকে স্বামীরুপী জানোয়ারের শারীরিক অত্যাচার মেনে নিতে বাধ্য করেন, আমার মোটামুটি গলায় আঙুল দিয়ে বমি করতে ইচ্ছে করে।
গুরুত্বের কারণে কিছু কথা পুনরুল্লেখ করিঃ
১) স্ত্রীর ইচ্ছার বিরূদ্ধে তার উপর যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়াটা বর্বর, পশুসুলভ আচরণ। স্বামী হওয়া মানেই “যখন ইচ্ছে তখন” স্ত্রীর উপর চড়াও হওয়া নয়। This goddamn act is as serious a crime as a non-marital one. আমাদের দেশের আইন বইয়ে এই ধারাটি এখনো আসেনি মানেই েই না যে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য।
২) RAPE IS NOT AN ACT OF SEX, IT IS AN ACT OF VIOLENCE- কোন স্বামী তার স্ত্রীর ইচ্ছার বিরূদ্ধে যৌনসংসর্গ করছেন-এর মানে তিনি সেক্স করছেন না, ভায়োলেন্স করছেন।
এবার পুলিশি অভিজ্ঞতা থেকে আবার অবজারভেশন বলি। প্রচুর পরিমাণ নারী নির্যাতনের কেইস আমার নিজের ডীল করতে হয়েছে,সহকর্মীদেরকেও দেখেছি ডীল করতে। স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের একটা অন্যতম উপসর্গ হচ্ছে এই মযারিটাল রেইপ।
যে স্বামী তার স্ত্রীর বিরূদ্ধে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হয়, দুদিন পরে এই স্বামী ওই স্ত্রীকে পিটিয়ে লাশ বানাবে এবং সবরকমের নির্যাতন করবে-এটা আমি মোটামুটি বাজি রেখে বলতে পারি।
এধরণের পরিস্থিতিতে যদি কেউ পড়ে থাকেন, Just get the hell out of that relationship. যদি এখন সম্ভব না হয় তবে অপেক্ষা করুন, প্রথম সুযোগেই বদমায়েশটার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করুন।
সমাজ খারাপ বলবে? সমাজ আপনার এবং আপনার পরিবারের সমালোচনা করবে??
করুক না, হোয়াই গিভিং আ র্যাটস আর্স?
আপনার জীবনের সুখ-দুঃখ পুরোটাই আপনার। পৃথিবীর কেউ, এমনকী আপন মা-ও সেই দুঃখ-কষ্টের ভাগ নিতে পারবেনা, বড়জোড় সবচাইতে আন্তরিকভাবে সান্তনা দিতে পারবেন।
বিয়ের পরের দিন ম্যারিটাল রেইপের শিকার হয়ে মেয়েটি যখন খুঁড়িয়ে হাঁটে, পরিবারের সদস্যরা মুখ টিপে হাসে, আর সেই হাসি দেখে গর্বে বুক ফুলে ওঠে স্বামী নামক নপুংশকটির। মেয়েটি ছাড়া কেউ জানেনা, এই ভয়াবহতার শিকার হয়ে মেয়েটি শারীরীক না হলেও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। আর মানসিকভাবে পঙ্গু মায়ের সন্তান আমরা বাঙালি ছেলেরা বড় হয়ে কি হচ্ছি, সেটা সবাই ত চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছি।
সময় এসেছে এই দুষ্টচক্রকে ভেঙে ফেলার!