ছেলেবেলায় নব্বইয়ের দশকে যাঁরা বড় হয়েছেন তাঁদের খুব সম্ভবত মনে আছে টিভি সিরিজ “দা সোর্ড অফ টিপু সুলতান” এর কথা। আজকের জনপ্রিয় নায়ক হৃত্তিক রোশন এর সাবেক শ্বশুর সঞ্জয় খান ছিলেন এর নায়ক।
যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ দেয় সাধারণ সেনাদল, বড়জোর সেনাপতি পর্যন্ত। ভোগ বিলাসে পরিপূর্ণ রাজা বাদশাহ সুলতানেরা শেষ পর্যন্ত অস্পৃশ্য রয়ে যান, শান্তিতে ত্যাগ করেন শেষ নি:শ্বাস। এঁনারা জন্মান সোনার চামচ মুখে নিয়ে, মারাও যান সোনার পালঙ্কেই। এঁদের নিয়েই লেখা হয় ইতিহাস, সত্যিকারের বীরেরা রয়ে যান আড়ালে।
এই রাজা রাজড়াদের ভীড়ে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম টিপু সুলতান। ১৭৯৯ সালে মহীশূরের রাজধানী শৃরঙ্গপত্তমে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনারা দখল নেয়, টিপু সুলতান তখনও আত্মসমর্পণ করেননি। একজন প্রকৃত বীরের মতই তলোয়ার হাতে বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করেন তিনি, ইংরেজরা যে মৃত্যুর নাম দিয়েছে dying with one’s boots on.
টিপু সুলতানকে ইংরেজরা এতটাই সম্মান করে, তাঁর একটা উক্তি বহু ইংরেজের মুখে মুখে ফেরে- Its better to live like a lion for a single day than living like a jackal for a hundred years. হিন্দি কবি তাঁকে নিয়ে লিখেছেন:
রুহ তো গয়ি তন সে জুদা,
হাত তলওয়ার সে জুদা না হুয়া..
(দেহ থেকে আত্মা চলে গিয়েছে, তবুও টিপুর হাত থেকে তলওয়ার আলাদা হয়নি)
এই লোকটি চাইলে হায়দ্রাবাদের নিজামের মত গোলামীর চুক্তিতে স্বাক্ষর করে নিরাপদে স্ত্রী পুত্র নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারতেন। ইংরেজরা যে আর দশটা জাতের মতই মানুষ, অপরাজেয় কিছু না- এই জিনিসটা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং সে বিশ্বাস বাকিদের ভেতরে ছড়িয়ে দিতেন। যে যান্ত্রিক বাঘটি দেখছেন এর নাম টিপু’স টাইগার। মহীশূরের পতাকা ছিল বাঘের ছাপ দেয়া, আর এই যন্ত্রটিতে চাবি দিলে দেখা যেত যান্ত্রিক বাঘ ইংরেজ সেনাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে, আর তার মরণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। টিপুর মৃত্যুর পর এটি ইংরেজদের হস্তগত হয়, বর্তমানে এলবার্ট মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে।
এছাড়াও আছে টিপু সুলতানের পিস্তল এবং তরবারী। শৃরঙ্গপত্তমের পতনের দিনে যখন রাস্তায় রাস্তায় সুলতানের সেনা আর কোম্পানির সেনার লড়াই চলছে, টিপু এক পর্যায়ে নিজেই তলওয়ার হাতে নেমে পড়েন ইংরেজ বধে। টিপুর তরবারির সামনে কচুকাটা হতে থাকে তারা, শেষে দূর থেকে দুজন ইংরেজ সেনা বুকে গুলি করে মৃত্যু ঘটায় দেশপ্রেমিক এই রাজার। টিপু লুটিয়ে পড়ার পর সেই সেনা তার সঙ্গীকে বলেছিল- I dont know who this man is, but he fought like a tiger.
দুশো পনের বছর পর শের এ মহীশূর টিপু সুলতানের তলোয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, বিমুগ্ধ বিস্ময়ে। বীরগণ জাতি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে, তাই ইংরেজরাও টিপুর বীরত্বকে আজও সম্মান জানায়।
পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ডকে বললাম, Can I have your cap, mate?
খালি মাথায় স্যালুট দেয়া যায়না, তাই ওর ক্যাপটা মাথায় দিয়ে পূর্ণাঙ্গ পুলিশি কায়দায় স্যালুট দিলাম একটা।
ব্রিটিশ সঙ্গিনী এমিলি পেছনেই ছিল। “You are his relative, Mash?”
ওর নীল নয়নে সপ্রশংস জিজ্ঞাসা।
আমি বললাম- এ পৃথিবীর সব মুক্তিযোদ্ধা আমার রক্তের আত্মীয়।
তারপর বিদ্রোহী কবির (আজ তাঁর মহাপ্রয়ান) দুলাইন গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে এলাম এমিলিকে সাথে নিয়ে-
আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন,
দিল ওহী মেরা ফাঁস গায়ি…!
উৎসর্গ: Niaz Morshed Chowdhury