কিছু কিছু মুহূর্ত আছে যা অনুভব করার পরে মনে হয়, মরে গেলেও আর আফসোস থাকবেনা। আমার ত্রিশ বছরের এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন মুহূর্ত বেশ কয়েক বার এসেছে। প্রেয়সীর প্রথম চুম্বন, সিলেটে কমান্ডোদের সাথে র্যাপেলিং করে হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপ দিয়ে মাটি ছোঁবার সময়টা, পুলিশ একাডেমিতে পাসিং আউট প্যারেড শেষ করে দৌড়ে বাবা মায়ের কাছে যাবার সেই উদ্দীপনা…এই অভিজ্ঞতাগুলো মৃত্যুর সময়ও ভুলব বলে মনে হয়না।
কাছাকাছি অনুভূতি হয়েছে ভ্যাটিক্যানের সিলিং-এ দি লাস্ট জাজমেন্ট কিংবা মাইকেলেঞ্জেলোর ভাষ্কর্য “পিয়েতা” দেখে।তবে আজ যে অনুভূতি হল, এর তুলনায় জীবন যৌবন তুচ্ছ।
আজ আমাদের পরিদর্শন ছিল রয়াল সোসাইটিতে, ব্রিটিশ বিজ্ঞানের সূতিকাগার এই রয়াল সোসাইটি। বয়স্কা গাইড মেরি পুরো এলাকা ঘুরে দেখালেন শুরুতে, তারপর নিয়ে গেলেন বেইজমেন্ট লাইব্রেরিতে। এখানে অতীব দুষ্প্রাপ্য এবং প্রাচীন কিছু বই সাজিয়ে রাখা আছে, কলম্বাস যে ম্যাপবই নিয়ে গিয়েছিলেন সেটার একটি কপিও দেখলাম। এর পাশের একটা বই খুব পরিচিত লাগছিল, সাহস করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম গাইডকে।
জিজ্ঞাসা করার পর যে উত্তর পেলাম তাতে হাত কাঁপাকাঁপি শুরু হল আমার, বুকের ভেতর শুরু হল ঘোড়াদৌড়। মাথায় হাল্কা চক্করও দিয়ে উঠল, প্রফেসর নর্টন খেয়াল করে চট করে আমার কাঁধ ধরে ফেললেন।
যে বইটা আমি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম ওটার নাম Philosophia Naturalis Principia Mathematica, লেখকের নাম স্যার আইজ্যাক নিউটন। এটা কোন রেপ্লিকা নয়, নিউটনের নিজ হাতে লেখা অরিজিনাল ড্রাফট। এই সেই বই, যেটার হাত ধরে ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। এই বইতেই আছে গতিসূত্র, নিউটনের নিজের হাতে লেখা। বন্ধু এ্যালেক্স হ্যালীর সহায়তায় এই বইটি নিউটন রয়েল সোসাইটিতে পাঠান, এই ম্যানুস্ক্রিপ্টটি তখন থেকেই এখানে সংরক্ষিত।
প্রিয় পাঠক, কোন শব্দই আমার অনুভূতি বোঝাতে যথেষ্ট নয়। শুধু মনে হচ্ছিল, আমার তুচ্ছ মানব জন্ম আজ ধন্য।
বিষ্ময়ের ওখানেই শেষ নয়। পাশেই দেখলাম রয়েল সোসাইটির সভ্যদের অটোগ্রাফের খাতা। মাথায় বিদ্যুতের মত খেলে গেল বাংলাদেশের দুজন বিজ্ঞানীর নাম। প্রথম জন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, যাঁকে নিয়ে কবিগুরু তাঁর বই “কথা ও কাহিনী” উৎসর্গ করেছিলেন নীচের পদবলীতে:
সত্যরত্ন তুমি দিলে, পরিবর্তে তার
কথা ও কাহিনী মাত্র দিলেম উপহার!
খুঁজে বের করলাম তাঁর অটোগ্রাফ, ধন্য হলাম পূণ্যস্পর্শে।
দ্বিতীয়জন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যাঁর নামে হিগস-বোসন কণা আর বোস-আইন্সটাইন সমীকরণ।
এই পোড়া দেশে দুহাজার পনের সালে এসে কলম বনাম চাপাতির লড়াইয়ে চাপাতি যখন ইনিংস ব্যবধানে জিতে চলেছে, সেই দেশের বিজ্ঞানবীরেরা এক সময় রয়াল সোসাইটি দাপিয়ে বেড়াতেন। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস!
সর্বশেষ যে অটোগ্রাফটি ছুঁয়ে মানবজন্ম সার্থক করলাম সেই ভদ্রলোকের নাম বলবনা। একটু হিন্টস দিই, “অরিজিন অফ স্পেসিস” বইটি তাঁর লেখা।
আপনাদের জন্যে উপরে বর্ণিত সবকিছুর ছবি তুলে এনেছি। এ প্রোফাইলে প্রায় হাজার পঞ্চাশেক অতিথি। আমার জীবদ্দশায় আপনাদের অন্তত: একজনকে কি ওই বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে দেখবনা?
একশ বছর আগে আচার্য জগদীশ আর তাঁর পরে সত্যেন বোস ধন্য করেছেন রয়েল সোসাইটিকে।
পরবর্তী জন আপনি হবেন না কেন?
বিজ্ঞানের জালিবেত দিয়ে পিটিয়ে যাবতীয় অন্ধত্ব, কুসংস্কার আর ভন্ডামী দূর করতে হবে, পশ্চাদ্দেশ লাল করে দিতে হবে অন্ধকারের শয়তানগুলোর।
এই আমাদেরকেই, এই জনমেই।