জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়‬: এক অদম্য লড়াইয়ের গল্প

ছাত্রছাত্রী সংখ্যার দিক দিয়ে বলুন তো কোন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম?

জ্বি, আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানকার ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনলে আমরা তথাকত্থিত এলিটের দল নাক সিঁটকাই|

আমার এ লেখাটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের জন্যে লেখা| প্রথমে ভেবেছিলাম এর সমস্যাগুলো নিয়ে লিখব, এখন ঠিক করেছি নাহ- সমস্যার বুলি বহু কপচানো হয়েছে| আমি ধরে নিচ্ছি বিদ্যমান সমস্যাগুলোর আশু কোন সমাধান নেই| এটা ধরে নিয়েই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা কিভাবে লড়তে পারে, তা নিয়ে লিখছি|

আত্মবিশ্বাস‬: জীবনে কোন একটা পরীক্ষায় খারাপ করেছে বলে, বাপের টাকা নেই বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা ছেলে বা মেয়েকে যে অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, এই নিষ্ঠুরতার তুলনা শুধুমাত্র সন্তান মারা গেলে মা কে অপয়া বলে খোঁটা দেবার নিষ্ঠুরতার সাথেই চলে| এই অপমান এক দিন না, দুদিন না, বছরের পর বছর ধরে চলে| আপন বাবা মা ভাই বোনও ছাড় দেয়না, বাইরের মানুষ এর কথা বাদই দিলাম|

আমার ব্যাচ (আটাশতম বিসিএস পুলিশ) এর প্রায় দুশো অফিসারের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি অফিসার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোডাক্ট| উনত্রিশ বিসিএস ফরেন সার্ভিস এর ফার্স্ট বয় মাহবুর রহমান ভাইও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের| এগুলো একসেপশন নয়, প্রতিটা বিসিএস এ প্রতিবার হচ্ছে|

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা এমন কোন জায়গা নেই যেখানে মেধার স্বাক্ষর রাখেনি| বাংলাদেশের সেরা বিজনেস স্কুল আইবিএ এর এমবিএ ব্যাচে খোঁজ নিয়ে দেখুন, প্রতি বছর জাতীয় ভার্সিটি গ্র‍্যাজুয়েটরা এর কতগুলো সীট দখল করে বুয়েট, এন এস ইউ, ডিইউ এর ছাত্রদের হারিয়ে দিয়ে|

আমি যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছেলেমেয়েকে দেখি, তার ভেতরে আমি অদম্য লড়াকু এক যোদ্ধার ছবি দেখতে পাই| আমি প্রাইভেটে পড়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে ক্লাস করেছি কিছুদিন, রাজশাহী ভার্সিটির একটা মাস্টার্স আছে , আর এখন পড়ছি জাপানে| বাজি লেগে বলতে পারি, এই ছেলেমেয়েগুলোর চেয়ে মেধায় বা সাহসে আমি এগিয়ে নই কোনভাবেই| যে ভয়াবহ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা পার হয়, আমাকে তার মধ্যে দিয়ে যেতে হলে স্রেফ নাই হয়ে যেতাম|

ভাগ্য তোমার সুযোগ বারবার কেড়ে নিতে পারে, কোন কারণে এ্যাডমিশন টেস্ট তোমার খারাপ হতে পারে, নিকটাত্মীয়ের কটূক্তি তোমার গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিতে পারে| তবুও বলি, নিজের উপর বিশ্বাস হারিও না|

Dont let the bastards have the pleasure to see you destroyed.

বিজয়ের প্রথম সূত্র এটা, ভুলে যেও না|

দক্ষতা‬: ব্র‍্যান্ড নেইম একটা বিশাল ব্যাপার, “নর্থ সাউথে আবার ইকোনমিক্স পড়ায় নাকি” টাইপ প্রশ্ন এই আমাকেই শুনতে হয়েছে বিসিএস এর ভাইভায়|
এটাকে উড়িয়ে দিতে হবে নিজের জ্ঞান দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে| এই ইন্টারনেট এর দুনিয়ায় জ্ঞান কারো পৈত্রিক সম্পত্তি না| Coursera জাতীয় ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে ফ্রি তে প্রায় সব সাবজেক্টেই হার্ভার্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্লাস করা যায়| তোমার এলিট বন্ধুটি যখন ফেসবুকে প্রেম করছে, তুমি তখন এই ক্লাসগুলো অনলাইনে করে নিজেকে তৈরি করতে পার| ইউটিউবে খান একাডেমি বা শিক্ষক ডট কম থেকে নিজের বেসিক শক্ত করে নিতে পারো(পিএইচডি লেভেলের ছাত্ররাও করে)| গুগল স্কলার, Citeseer X এই ওয়েবসাইট গুলোতে যে কোন বিষয়ের সেরা একাডেমিক পেপারগুলো ফ্রি পড়া যায়|

সেশন জ্যাম তোমার সময় কেড়ে নিচ্ছে? এই সময়টা দাও নিজেকে গড়তে, নিজেই হও নিজের শিক্ষক| তারপর সুযোগ মত তাক লাগিয়ে দাও সারা বিশ্বকে|

Those who counted you out will be facing the biggest surprise of their life, trust me.

তুমি যদি কাজ জানো, মূল্যায়ন তোমার হবেই|

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যার শেষ নেই| মোটা দাগে সমস্যাগুলো এরকম:

1) সেশন জ্যাম
2) দুই দিন পর পর সিস্টেম পরিবর্তন
3) কলেজের অবকাঠামোর অভাব
4) শিক্ষক ক্লাস অসামঞ্জস্য (একটা আছে তো আরেকটা নাই)
5) কেন্দ্র আর কলেজের দূরত্ব ( হেডকোয়ার্টার গাজিপুর কিন্তু কলেজ সারাদেশে)
6) রাজনৈতিক অনাচার
7) দুর্নীতি ( প্রাইভেট পড়ানো কালচার)

এগুলো সব মিলে তথাকথিত সমাজের সহায়তায় মেরুদণ্ড ছিনিয়ে নিতে চায় সবাই, যাতে ছেলেটি বা মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে| তবুও তারা লড়ে যায় বিশাল সিলেবাস সমুদ্রে সাঁতার কেটে, যার প্রশ্ন কে করবে, পড়ানো হয়েছে যেগুলো তার ভেতর থেকে আসবে কিনা তা ওরা জানেনা|

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলমন্ত্রটা উল্লেখ করি:

“সব জ্ঞানীর উপরে আছেন এক মহাজ্ঞানী”

দাঁতে দাঁত চেপে জ্ঞানার্জনের লড়াই চালিয়ে যাও, উপরের মহাজ্ঞানী তোমায় দেখছেন|

The World Is Yours

Comments

comments