অর্জুনের হাতে ওটা কি, অঞ্জলীক অস্ত্র না?? আহ! কত শুনেছি এটার কথা! মুখটা অর্ধচন্দ্রের মত, যখন আঘাত করে এক ধাক্কায় কল্লা নামিয়ে দেয়- ব্যাথা টেরই পাওয়া যায়না। শ্রীকৃষ্ণকেও দেখতে পাচ্ছি, অর্জুনকে কি জানি বলছে। রথের চাকা মাটিতে বসে যাওয়ায় আমার এই জন্মশত্রুকে বলেছিলাম একটু দাঁড়াতে।
দাঁড়িয়েছিলও ও, কৃষ্ণের কথায় আবার হাতে ধনুক তুলে নিয়েছে।কি ভয়ঙ্কর সুন্দরই না লাগছে দেখতে!!!! সারাজীবন এই ছেলেটাকে ঘৃণা করে এসেছি, আজ মরার ঠিক আগ মুহূর্তে মনে হচ্ছে-নাহ, দ্রৌপদী ঠিকই করেছিল ওর গলায় মালা দিয়ে।দ্রৌপদীর মালা রাজার পুত্রের গলাতেই মানায়, সূতপুত্রের আবার হৃদয় আছে নাকি? হৃদয়ই যার নেই, তার আবার রক্তক্ষরণ!
হায় রে, এই অন্তিম মুহুর্তে দ্রৌপদীর কথাই বার বার মনে পড়ছে। স্বয়ম্বর সভায় প্রথম দেখা ওর সাথে, প্রথম দেখাতেই প্রেম।ভেবেছিলাম নিজ বাহুবলে জয় করব ওকে, সারা পৃথিবী ওর পায়ের কাছে এনে রাখব।
আচ্ছা, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মুখের কথাগুলো বুঝি সবচাইতে বেশি প্রানে আঘাত করে?
“আমি সূতপুত্রের গলায় মালা দিতে পারবনা”-মাত্র ছয়টা শব্দে কি নির্মম আঘাতটাই না দিয়েছিল ও আমাকে! মনে হচ্ছিল মাটির সাথে মিশে যাই, ছুঁড়ে ফেলি এতদিনের সাধনার ধন যুদ্ধবিদ্যার ঝুলি। আকাশের দিকে তাকিয়ে পিতা সূর্যকে বলেছিলাম- “হে পিতা, দেখো, তোমার সন্তানের এই বঞ্চনার ইতিহাস তুমি মনে রেখো”
তা তিনি মনে রেখেছিলেন, এবং কৌরবদের সভায় সে অপমান ফিরিয়ে দেবার সুযোগও দিয়েছিলেন। যে নারীরত্নের জন্যে হাসিমুখে জীবন বিসর্জন দেয়া যায়, যুধিষ্ঠির কিনা তাকেই পাশাখেলায় বাজী লাগল!!!!! ছিঃ
দ্রৌপদীর প্রেমে অন্ধ ছিলাম, ঘৃণাটাও তাই অন্ধই ছিল। সারাজীবন যেটাকে নিজের সবচাইতে বড় সম্পদ বলে জেনে এসেছি, সেই ভদ্রোচিত পৌরুষকেই কিনা ছুঁড়ে ফেললাম অন্ধ আক্রোশে! যে নারীকে পেলে ধন্য হত আমার জীবন- মুখ ফুটে তাকেই বলে বসলাম “বেশ্যা!”
দ্রৌপদী কখনও জানবেনা- সেদিনের ওই আচরণের জন্যে নিজের প্রতি ঘৃণার কি সুতীব্র বিষ বহন করে চলেছি প্রতিদিন। অর্জুনকে ধন্যবাদ, আমার শির দ্বিখণ্ডিত হবার পর প্রাণের সাথে এই বিষটুকুও মিলিয়ে যাবে শূন্যে, মুক্তি পাবে আমার আত্মা!
ক্ষত্রিয় আমি, রণক্ষেত্রে মৃত্যু আমার কাছে ফুলসজ্জার চাইতেও আরাধ্য। ন্যায় বনাম অন্যায়ের এই যুদ্ধে ভাগ্য আমাকে পাঠিয়েছে অন্যায়ের পক্ষে লড়তে। দিনশেষে ন্যায়পক্ষ জয়ী হবে এ তো বিধির বিধান। তবুও, যে যুদ্ধটুকু আমি শিখেছি মনপ্রাণ দিয়ে- যে বিদ্যার দ্বারা মুছে ফেলেছি নীচু জাতের তকমা, সেই বিদ্যার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশই আমার জন্মের সার্থকতা।জয় বা পরাজয় আমার হাতে নেই, আছে শুধু লড়াই করার অধিকার। শত প্রলোভনেও এই অধিকারটুকু ছাড়িনি।
যুদ্ধের শুরুতে কৃষ্ণ এসেছিল, জানিয়ে দিয়েছিল আমার আসল পরিচয়। রথচালক অধিরথ আর জননী রাধার পুত্র আমি নই, আমি আসলে কৌন্তেয়-কুন্তীর পুত্র, চিরশত্রু অর্জুন আমারই ভাই!
উহ! কি দুঃসহ সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেদিন! টলে উঠেছিল পরিচিত পৃথিবী, চেনা মুখগুলো সব অচেনা হয়ে গিয়েছিল।
জানি, চলে গেলেই পারতাম কৃষ্ণের সাথে, হতে পারতাম রাজাধিরাজ। শুধু তাই নয়, দ্রৌপদীর স্বামীত্বের এক ভাগও বরাদ্দ হত আমার জন্যে।
কিন্তু না, পৌরুষ দিয়ে যে নারীরত্ন আমি জয় করতে পারিনি ভাগ্যের কূটচালে, রাজনীতির কূটচালে তার শয্যায় আমি যেতে পারবনা।যাকে বেশ্যা বলে নিজের পৌরুষ বিসর্জন দিয়েছিলাম, তাকে বিসর্জন দিয়েই ফিরিয়ে নিলাম ভদ্রোচিত পৌরুষের গৌরব। আর রাজত্ব? গাড়োয়ানের ছেলে কর্ণের ওসব দরকার নেই- ও নিয়ে বরং কুরুপাণ্ডবেরা মারামারি করুক।
কৃষ্ণ চলে গেল যুদ্ধের দিনক্ষণ ঠিক করে, তারপর এলেন কুন্তীদেবী।
বিশ্বাস করুন, এই মহিলাকে দেখে কিছুমাত্র ভক্তিশ্রদ্ধার উদয় হয়নি আমার।শিশু অবস্থায় অসহায় যে বাচ্চাটাকে যিনি পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই আজ এসেছেন সেই ছেলেকে ফিরিয়ে নিতে। তাও ভালবাসার টানে না, নিজের পুত্রদের রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা করতে।
অধিরথ আর রাধা রথচালক পরিবার হতে পারেন, কিন্তু সেই ফেলে দেয়া বাচ্চাটাকে তাঁরা কোলে তুলে নিয়েছিলেন, কোনওদিন কোন অভাব রাখেননি। হ্যাঁ, টাকাপয়সা তাঁদের ছিলনা, কিন্তু যে ভালবাসার কাঙাল আমি ছিলাম- সেটা তাঁরা দিয়েছেন দু’হাত ভরে।রাজ জননীর সুবিধাশ্রয়ী ডাকে সাড়া দিয়ে দুঃখের দিনের আশ্রয়দাত্রীর অসম্মান আমি করতে পারিনি।
জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়না, মায়ের কর্তব্য পালন করা লাগে। শিশু কর্ণের প্রতি ওই কর্তব্য পালন করেছিলেন রাধা, তাই রাধেয় পরিচয় নিয়েই আমি বাঁচতে চেয়েছি, কৌন্তেয় নয়।
এই তো, আর কয়েক মুহূর্ত পরে কুন্তীদেবী ফেলবেন স্বস্তির নিঃশাস, আর বুক ফাটা কান্না কাঁদবেন আমার রাধা মা। আহ, মা গো! তোমার কর্ণ রাধেয় হিসেবেই মরেছে মা,আদরের ঋণ শোধ করতে ভোলেনি!
অর্থের লোভ কোনকালেই ছিলনা আমার, ছিল শুধু বিদ্যার লোভ। দ্রোণাচার্যের কাছে গেলাম, রাজার ছেলে নই বলে নিলেন না তিনি। এরপর গেলাম পরশুরামের কাছে, ব্রাহ্মন পরিচয়ে। জীবনে এই একটি বারই মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি, শিক্ষার লোভে। বিদ্যাশিক্ষায় সব ছাত্রকে ছাড়িয়ে গেলাম, গুরু আমাকে ভালবাসতে লাগলেন পুত্রের মত। একদিন তিনি আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ কোত্থেকে একটা ভ্রমর এসে গুল ফোটাতে লাগল আমার উরুতে। পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন গুরু, নড়লেই উনার ঘুম ভেঙে যাবে।তা কি হতে দিতে পারি?
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করেছিলাম কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, ভ্রমরের দংশনে রক্ত বেরিয়ে গুরুর গায়ে পড়ল, ভেঙে গেল তার ঘুম। উঠেই তিনি বললেন, কোন ব্রাহ্মনের পক্ষে এই যন্ত্রনা সহ্য করতে পারার কথা না-সত্যি করে বল তুই কে?
বুঝলাম, ধরা পড়ে গিয়েছি। পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বললাম, গুরু, আমি ক্ষত্রিয়, সূতপুত্র বলে কেউ আমাকে বিদ্যাশিক্ষা দেয়নি তাই আপনার কাছে এসেছি।কাজ হলনা, তিনি বললেন, ” যে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছি, চরম বিপদের সময় ওটা ব্যবহার করা তুই ভুলে যাবি”
হায়, একারণেই তো কিছুতেই মনে করতে পারছিনা ব্রহ্মাস্ত্রের ব্যবহার!
গরীব এক শিশুর হাত থেকে ঘি পড়ে গিয়েছিল মাটিতে, ওই ঘি খেতেই সে কাঁদছিল। আমি মাটি থেকে ঘি লাগানো ধূলিটুকু মুঠোয় পুরলাম, চাপ দিয়ে বের করে দিলাম পাত্রে। তখন কি জানতাম, আমার হাতের চাপে ভূমিদেবী কষ্ট পাবেন? তিনি অভিশাপ দিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে আমার রথের চাকা মাটিতে ঠিক ততটাই শক্তভাবে বসে যাবে, যতটা শক্তভাবে আমি ভূমিকর্ষণ করেছি।
তাই তো এত চেষ্টাতেও রথ ওঠাতে পারলাম না।আমার হাতের আকর্ষণে পৃথিবী চার আঙুল উঁচু হয়ে গেল, তবু রথের চাকা উঠল কই?!
অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনীর দিন অর্জুনের সাথে লড়তে চাইলাম, সূতপুত্র বলে সবার সামনে আবারও অপমান করা হল আমাকে। যাকে আপনারা সবাই খারাপ বলেন, সেই দূর্যোধনই সেদিন আমার সম্মান রক্ষা করেছিল, অভিষিক্ত করেছিল অঙ্গরাজ্যের রাজত্বে। সেই ঋণ শোধ করে আসছি এতদিন, আজ প্রাণ দিয়ে তার দায়মুক্তি ঘটাতে যাচ্ছি।
এ যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে পাণ্ডবেরাই আছে, দুর্যোধনের দাবী অন্যায়। পাণ্ডবদের নানাভাবে, নানা উপায়ে বঞ্চিত করেছে কৌরবরা।তবে পাণ্ডবরাও পিছিয়ে নেই- কৃষ্ণের কূটচালে সাপের মাথার মত যে প্রাণঘাতি তীর আমি ছুঁড়েছিলাম , ওটা এড়িয়ে গেল অর্জুন।এই কৃষ্ণ কিনা কথা দিয়েছিল যুদ্ধে যোগ দেবেনা!
ঈগলপাখি কচ্ছপকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবার আগে তার শক্ত খোলটা ভেঙে নেয়। জন্মেছিলাম কুন্তল-কবচ নিয়ে, অর্জুনের বাবা ইন্দ্র সেটাও নিয়ে গেলেন। সেদিনই বুঝেছিলাম আমার ললাট লিখনে কি আছে।
যাই হোক, আমার লড়ার কথা ছিল, লড়েছি- এবং তা সর্বশক্তি দিয়ে। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও পক্ষত্যাগ করিনি, বন্ধুত্বের জবাব বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে দেইনি।
শুনতে পাচ্ছি, কৃষ্ণ মনে করিয়ে দিচ্ছে অর্জুনকে কিভাবে বালক অভিমন্যূকে হত্যা করেছিলাম, কিভাবে কটুকথা বলেছিলাম দ্রৌপদীকে। ভালই হয়েছে, যেটুকু পাপ লেগেছে শরীরে, রক্ত দিয়ে তা মুছে যাবে ।
এই তো, গাণ্ডীবের টঙ্কার শুনতে পাচ্ছি, বাতাসে শীষ কেটে এগিয়ে আসছে অঞ্জলীক তীর…
আমার মৃত্যুতে অধর্ম থেমে যাবেনা, ধর্ম অধর্মের লড়াই চলবে যুগের পর যুগ। ন্যায়পক্ষে যে যোদ্ধা লড়বে তাকে অভিনন্দন, কিন্তু বিলক্ষণ জানি আমিই শেষ কর্ণ নই।
হাজার বছর পরেও কর্ণেরা থাকবে, যারা স্রেফ ভাগ্যের দোষে যোগ দেবে অত্যাচারী শিবিরে। উৎপীড়িতের ক্রন্দনের দায় আর কাউকে না পেরে ওই কর্ণের দিকেই ছুঁড়ে দেবে নপুংশকের দল। তারা কখনও জানবেনা, কর্তব্যের নাগপাশে কর্ণ আষ্টেপৃষ্টে বাধা- অন্যের কুকর্মের দায় তার নয়। কর্ণ শুধু লড়তে চেয়েছে, নিজের সাধ্যমত- সবটুকু উজাড় করে।
কে জানে, আগামীর এক দুজন কর্ণ হয়ত অন্যায় সমরে পড়েও জয়ী হয়ে যাবে!
… অঞ্জলীক তীরের ফলাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি- সূর্যের আলোয় কি দারুণ ঝিকমিক করছে! আচ্ছা, আমার রক্ত আর ওই সোনালী ফলা মিলেমিশে যে রঙ ধারণ করবে, সেটা কি রঙধনুর চাইতেও সুন্দর?!!
আহ…
( মহাভারতে আমার সবচাইতে প্রিয় চরিত্র সুর্যপুত্র কর্ণের অন্তিমকালের ভাবনাগুলো ধারণ করতে চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের প্রতি এক দীনহীন পাঠকের এ এক অক্ষম শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন।যে কোন মতামত/সমালোচনা সাদরে আমন্ত্রিত।)