পুস্তক সমালোচনাঃ দি ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড

মহাভারতের কর্ণ, ইলিয়াডের হেক্টর আর মধুসূদনের মেঘনাদ- এদের মধ্যে মিল কোথায় বলুন তো? এরা প্রত্যেকেই বীর যোদ্ধা, পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্বে এঁরা ম্লাণ করে দিয়েছেন শত্রুমিত্র উভয় পক্ষের বীরদের| নিয়তির অমোঘ বিধানে এঁদের গলায় বিজয়মাল্য ওঠেনি, কিন্তু পরাজয়ের তিলক তাঁদের কারো সূর্যসম ঔজ্জ্বল্যকে ম্লাণ করতে পারেনি এতটুকু| ভাগ্যের ফেরে এঁরা লড়ছেন অন্যায় সমরে, পরাজয় যেখানে সুনিশ্চিত| তবুও এরা যোদ্ধার জাত, পরাজিতের পক্ষ ত্যাগ করে চিরগ্লাণিমায় নিমজ্জিত হবার চাইতে বীরের মত মৃত্যুই এঁদের পরম আরাধ্য| দে যাস্ট ওয়ান্ট টু ডাই উইথ দেয়ার বুটস অন, বিজয় অথবা বীরগতিপ্রাপ্তি- এটাই এই বীরদের জীবনের লক্ষ্য| ঠিক যেন “রক্তাক্ত প্রান্তর” এর মারাঠা অধিপতি মুসলমান বীর ইব্রাহিম কার্দি!

“একজন মুসলিম হিসেবে আমিও চাই মুসলিমদের বিজয়, কিন্তু যে মারাঠারা আমার বীরত্বের সম্মান করেছে, প্রাণ থাকতে তাদের বিপদের সময় পক্ষত্যাগ করবনা| জয় পরাজয় যাই আসুক, মৃত্যু ভিন্ন আমার মুক্তি নেই”

প্রিয় পাঠক, দীর্ঘ ভূমিকা শেষে ঠিক এরকম এক ট্রাজিক হিরোর সাথে আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি: জার্মান সেনাবাহিনীর স্পেশাল অপারেশন ইউনিটের কমান্ডার লে:কর্নেল কুর্ট স্টেইনার|

জ্যাক হিগিন্স মিলিটারি থ্রিলার জনরার সবচাইতে নাম করা লেখকদের একজন, আর “দ্য ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড” হচ্ছে তাঁর ম্যাগনাম ওপাস| ইতিহাসভিত্তিক মিলিটারি থ্রিলারের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বইটির অন্তত: পঞ্চাশ ভাগ তথ্য ইতিহাসের বইগুলোতে পুরোপুরি ডকুমেন্টেড আকারে রয়েছে| সত্য আর কল্পনার মিশেলে মহিমান্বিত বীরত্বের যে দুর্ধর্ষ থ্রিলার জ্যাক হিগিন্স লিখেহেন, তার তুলনা অন্তত: আমি দ্বিতীয়টি পাইনি|

ওটো স্করজিনি কমান্ডোদের ইতিহাসের সবচাইতে নাম করা চরিত্র, জার্মানদের প্রথম কমান্ডো ইউনিটের প্রধান এই অফিসার হিটলারের হয়ে মিত্রপক্ষের হাত থেকে মুসোলিনিকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করেছিলেন| অবিশ্বাস্য এই অপারেশনের পুরো বর্ণনা উইকিপিডিয়াতে পাবেন| মিত্রপক্ষ এই অপারেশনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে যুদ্ধের পর স্করজিনিকে স্রেফ বেকসুর খালাস দেয়া হয়|

স্করজিনির এই মিরাকুলাস অপারেশন হিটলারের মাথায় আরেকটা কিম্ভুতকিমাকার চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়:

Why not doing the same with Churchill, from the soil of England? It doesn’t take an entire army, all it takes is a few brave men daring all odds.

অন্য অনেক পাগলামির মত এটাকেও জার্মান আর্মির হাই কমান্ড পাত্তা দিচ্ছিলনা, কিন্তু অবিশ্বাস্য একটা সুযোগ সবাইকে নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য করল| ওয়েলশের এক উপকূলীয় অস্ত্র কারখানা পরিদর্শন করবেন চার্চিল, তারপর দুদিন বিশ্রাম নেবেন ওখানের একটা প্রাইভেট ফার্মহাউসে- এই তথ্য আকস্মিকভাবে পৌঁছলো জার্মান ইন্টেলিজেন্সের কাছে|

উপর মহল থেকে নির্দেশ এল, খুঁজে বের কর এমন একজন অফিসারকে, যে শুধু দুর্ধর্ষ কমান্ডোই নয়, ইংরেজ সেজে ছোট একটা জার্মান কমান্ডো ইউনিটকে নিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে অপারেশন করার যোগ্যতাও যে রাখে|

এরকম কি কেউ আছে জার্মান আর্মিতে?

ইহুদী কিশোরীকে ধর্ষণ না করার নির্দেশ অমান্য করা বেয়াড়া সৈনিককে হত্যা করে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হচ্ছিল ঠিক এমন একজন অফিসার| কোর্ট মার্শালের ভয় দেখিয়েও এই উদ্ভট মিশনে রাজী করানো যায়নি তাকে, তাই তার বাবা মেজর জেনারেল পদবীর আরেক অফিসারকে বন্দী করল গেস্টাপো| বলা হল,

All your problems will be solved, if you can pull this off.

আমাদের গল্পের নায়ক এই দুর্ধর্ষ অফিসারের নাম আবার বলি, ওবার্স্টলেফটেনেন্ট( লে: কর্নেল) কুর্ট স্টেইনার অফ দি ফলশার্মজ্যাগার( স্পেশাল এ্যাসল্ট ইউনিট)| মা আমেরিকান, পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা লন্ডনে, বাবা যেখানে মিলিটারি এটাশে ছিলেন|

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের মত উন্মাদের এতদিন টিকে থাকার অন্যতম কারণ জার্মান সেনাবাহিনীর জাতিগত বৈশিষ্ট্য স্টেট অফ দা আর্ট টেকনলজি, প্রফেশনালিজম, ডিসিপ্লিন এবং প্রশ্নাতীত দক্ষতা| তার এ্যাডভাইজরি প্যানেলে থাকত বিনাবাক্যে নির্দেশ পালন করা প্রচন্ড মেধাবী সব মিলিটারি পার্সোনেল, আর ফিল্ডে থাকত কুর্ট স্টেইনারের মত নিবেদিতপ্রাণ অফিসারেরা|

শিক্ষিত, মানবিক ও অদম্য সাহসী স্টেইনার ঘৃণা করত হিটলার আর তার পলিসিকে, কিন্তু পেশাগত কারণে এবং নীতির প্রশ্নে অটল থেকে সে মিশন থেকে পিছিয়ে পড়েনি|

বিচিত্র সব কৌশল অবলম্বন করে গোটা মিত্রবাহিনীকে ঘোল খাইয়ে স্টেইনার আর তার সহযোদ্ধারা চার্চিল হত্যার মিশন প্রায় সফল করে ফেলেছিল| কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ও পারেনি শেষ পর্যন্ত|

জার্মানদের একটা কমান্ডো ইউনিট, যাদের কোড নেইম “ঈগল” , কিভাবে সমস্ত বাধা ছিন্নভিন্ন করে খোদ ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রায় এ্যাসাসিনেট করেই ফেলেছিল চার্চিল দি গ্রেটকে?

কেনই বা চার্চিল পর্যন্ত বিমুগ্ধ বিস্ময়ে বলে ফেলেছিলেন, “German or not, he was a brave man and a great soldiar, see to him, Colonel!”

উত্তর জানতে চাইলে পড়ুন ফ্যাক্ট আর ফিকশনে মেশানো এই বুলডোজার-অফ-আ-বুক, আনস্টপেবল পেইজ টার্নার, The Eagle Has Landed.

আমি নিশ্চিত, বইটি শেষ করার পর কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকবেন আমার মত| একেবারে শেষের দিকের অকল্পনীয় একটা টুইস্টে স্তব্ধ হয়ে যাবে আপনার পাঠক মন|

সবশেষে মনে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এরকম একটা থ্রিলার কি কখনো লেখা হবেনা?!

Comments

comments