ট্রাম্পের দেশে উচ্চশিক্ষাঃ এ্যাডমিশনের চৌদ্দগুষ্টি

এ লেখাটা মূলতঃ যারা একেবারেই কিছু জানেন না তাদের জন্য।হয়ত  শুনেছেন মানুষ আমেরিকায় পড়তে যায়, শুনে শুনে আপনারও ইচ্ছা হয়েছে ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতে।আপনি হতে পারেন প্রথম বর্ষের ছাত্র, হয়তো স্কুল বা কলেজে পড়েন- জানতে চান আমেরিকায় পড়াশোনা সম্পর্কে। এ লেখাটি আপনাকে পুরো প্রসেস সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেবে। একটা ব্লগ পড়েই পরের দিন আমেরিকায় পা রাখাটা একটা অবাস্তব, অসম্ভব কল্পনা- সে চেষ্টাও করছিনা। আমার লক্ষ্য আপনাকে একটা বেসিক আইডিয়া দেয়া, যেটার উপর ভিত্তি করে আপনি নিজেই পথ খুঁজে নেয়া শুরু করতে পারেন। আমি নিশ্চিত, এই লেখা পরার পর আপনার ভেতরে আরও ডজন খানেক প্রশ্ন জন্ম নেবে, সেগুলোর উত্তর খুঁজতে আপনি আরও ঘাঁটাঘাটি করবেন, এবং একটা সময়ে দেখবেন নিজে নিজেই অনেক কিছু জেনে ফেলেছেন। লেখা শুরু করার আগে কয়েকটা ডিসক্লেইমার দিয়ে নিইঃ

এক) জীবনে সাফল্য অর্জনে আমেরিকার টপ স্কুলগুলতে আসাটা বাধ্যতামূলক নয়। “হায়ার এডুকেশন ইন ইউএস” একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা, এটা মানুষ হিসেবে আপনাকে অনেকটাই পাল্টে দেবে- অনেক কিছু জানবেন, দৃষ্টিভঙ্গী প্রচুর প্রসারিত ও পরিবর্তিত হবে, খুলে যাবে হাজারটা দুয়ার। এগুলো মাথায় রেখেই বলছি, পৃথিবীতে হাজার হাজার অসাধারণ মানুষ আছেন যারা আমেরিকায় পড়াশোনা করেননি, হয়ত কখনও দেশের বাইরেও যান নি। এই মানুষগুলো তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন অসামান্য কিছু কাজ করেছেন যা মানব সভ্যতার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হার্ভার্ডে পড়েননি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিলেন না। এত বড় বড় উদাহরণ ছাড়াও অন্য উদাহরণ আছে- ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামের “প্যাডম্যান” খ্যাত অরুনাচলম মুরুগননাথম সম্পূর্ণ নিজের জ্ঞান বুদ্ধিতে খুব সস্তায় স্যানিটারি প্যাড বানিয়ে লক্ষ লক্ষ নারীর জীবন রক্ষা করেছেন, নিজেও হয়েছেন মিলিওনেয়ার। উনি আইআইটি(ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, আমাদের বুয়েটের মত ভারতের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল) বা আইআইএম( ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, আমাদের আইবিএ এর মত) এ পড়েন নাই , বরং উনার জীবন নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা করেছে। “আমেরিকা=সাফল্য” এই যদি আপনার মনোভাব হয়ে থাকে এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমাদের দার্শনিক ক্যাপ্টেন মাশরাফি মুর্তজা যেমন বলেছেন সেটা একটু ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, নিজেকে আপনি এত সস্তা ভাববেন না যে আপনার মূল্য নির্ধারন করে দেবে তথাকথিত কোনও দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি।

দুই) একটা এলিট বা আঁতেল শ্রেণী আছেন যারা আমেরিকায় পড়াশোনা করতে আসাটাকে উচ্চবর্নীয় ব্রাহ্মণশ্রেণীর অতি অসাধারণ একটা বিষয় বানিয়ে রেখেছেন।এনাদের কাছে আমেরিকায় পড়তে আসাটা একটা রাজধর্ম, অতি অল্প কিছু মঙ্গলগ্রহের মেধাবীদের জন্য যেটা বরাদ্দ- বাকিরা এলে জাত নষ্ট হয়ে যায়। আমেরিকাতে পড়াশোনা করা এমন মানুষ দেখেছি যারা মানুষ হিসেবে এতই নিম্নশ্রেণীর যে ভুলে এদের সাথে হ্যান্ডশেইক করলে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা লাগে।উল্টোটাও  আছে- নিজের ফিল্ডে বিশ্বের অন্যতম সেরা হবার পরেও কিছু মানুষের মানবিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়েছি। সারমর্ম হচ্ছে, আমেরিকায় পড়তে আসাটা আর দশটা প্রতিযোগিতামূলক কাজের মতই  একটা কাজ । একজন সাধারণ ছাত্রও যদি পদ্ধতিটা জানে এবং সদিচ্ছা নিয়ে চেষ্টা করে- তার পক্ষে এই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করাটা খুব অবাস্তব কিছু না।

তিন) লেখাটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা, কাজেই এটা “ওয়ান সাইজ ফিট অল” নয়। একটা লেখায় বিশ্বের সবগুলো বিষয়ের খুঁটিনাটি তুলে ধরা অসম্ভব।আমি পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স করছি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে- কাজেই এ লেখাটা নন-টেকনিকাল বিষয়ে মাস্টার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করতে চান এমন ছাত্রছাত্রীদের সবচাইতে বেশি কাজে আসবে। সাহিত্য, দর্শন, ব্যবসা প্রশাসন, ইঞ্জিনিয়ারিং( তার ভেতরে আবার নানারকম শাখা প্রশাখা) প্রতিটায় এ্যাডমিশন প্রসেস খুব সূক্ষ্ণভাবে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে- এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিজে গবেষণা না করলে বোঝা সম্ভব না। এটার জন্য সময় দিতে হবে, শ্রম দিতে হবে, নিজে নিজে খাটাখাটি করতে হবে- ম্যাজিক পিলের মত অন্য কেউ এসে গুলিয়ে খাইয়ে দিতে পারবে না। আমেরিকান এ্যাডমিশন প্রসেস অনেকটা ডেটিং-এর মত, যে মেয়ের সাথে ডেট করবেন তার সম্পর্কে অন্যরা যাই বলুক নিজে তার সাথে না মিশলে বুঝবেন না সে কেমন, আপনার সাথে তার খাপ খায় কিনা। একইভাবে, এই প্রসেসের ভেতর দিয়ে নিজে না গেলে কখনি বুঝবেন না বিষয়টা কিভাবে কাজ করে। আন্ডারগ্রাড এবং পিএইচডি এ্যাডমিশন প্রসেসও আমার এই লেখার সাথে হুবহু মিলবে না, কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আলাদা হবে। এটা এই লেখার সীমাবদ্ধতা তা সবিনয়ে স্বীকার করে নিচ্ছি। এছাড়াও এ লাইনে রাগিব হাসান ভাই, আমার বন্ধু ইশতিয়াক, ফরহাদ হোসেন মাসুম, বড়ভাই ইশিতিয়াক রৌফসহ নাম উল্লেখ করলে বিব্রত হবেন এমন অনেক প্রিয়জন আছেন যারা অনেক বেশি জানেন। যদি আমার লেখার সাথে তাঁদের কোনও মতামত সাংঘর্ষিক হয় সেক্ষেত্রে তাঁদের মতামত বেশি গুরুত্ব দেবেন। নিজেকে “এক্সপার্ট” দাবী করার মত ধৃষ্টতা আগেও ছিলোনা, এখনও নেই- আশা করি কখনঅই হবেনা।লেখার ভুলত্রুটির সমালোচনা সাদর আমন্ত্রিত।

এই তিনটা বিষয় মাথায় রেখে চলুন শুরু করা যাক!

প্রথম ধাপঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণ

আপনি সবার আগে চিন্তা করবেন- কেন আপনি আমেরিকাতে পড়তে যেতে চান, আপনার উদ্দেশ্য কি, এই ডিগ্রি নিয়ে আপনি কি করবেন। হুট করে সিদ্ধান্ত নেবেন না, ধীরে সুস্থে মাথা ঠাণ্ডা করে সময় নিয়ে চিন্তা করুন। আপনি যে লাইনে পড়াশোনা করছেন  সে লাইনের জন্য কি আমেরিকা ভাল নাকি অন্য দেশে অনেক ভাল কাজ হচ্ছে?

ধরা যাক আপনি জানেনই না কি পড়তে চান- ইকোনমিক্স, সাইকোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং  নাকি এমবিএ । যেটাই পড়তে চান না কেন আপনাকে আগে জানতে হবে এই বিষয়ে মাস্টার্স করার মত ন্যূনতম যোগ্যতা আপনার আছে কিনা। এই ন্যূনতম যোগ্যতা জানতে আপনাকে যেতে হবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। কিভাবে খুঁজবেন সেটা? একটা সিম্পল উদাহরণ দেই(এটা একটা উদাহরণ মাত্র, হুবহু এই সাইটেই ঢুকতে হবে এমন কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই): 

মনে করলাম আপনি পড়তে চান ফিজিক্স। “Higher studies in Physics” লিখে গুগল করুন। এরকম একটা পেইজ আসবেঃ

এইবার এটার ভেতরে গেলে দেখবেন এরকমঃ

হলুদ একটা বার দেখছেন? ক্লিক করুন, দেখবেন এরকম একটা লিস্ট এসেছেঃ

এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিজিক্সের জন্য বিশ্বের প্রথম ছয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের লিস্ট, যার প্রথম তিনটাই আমেরিকার। এক নাম্বারে আছে এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি)। Massachusetts Institute of Technology Physics লিখে গুগল করলে এইটা আসবেঃ

দেখতে পাচ্ছেন এমআইটি ডিপার্টমেন্ট অফ ফিজিক্সের ওয়েবসাইট? এইটায় “গ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম” এ ক্লিক করলে দেখবেন এরকম একটা পেইজ আসছেঃ

এখন এইখানে ঘাটাঘাটি করলে বুঝতে পারবেন এমআইটি তে ফিজিক্স করার জন্য যেসব ন্যূনতম যোগ্যতা দরকার সেটা আপনার আছে কিনা, এপ্লিকেশন করতে গেলে কি কি জমা দিতে হবে, কয়টা রেকমেন্ডেশন লেটার লাগবে, স্টেটমেন্ট অফ পারপাসে কি কি জানতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কাজটা যদি করেন, তাহলে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে তার সময় নষ্ট এবং বিরক্তি উৎপাদন কোনোটাই করতে হবেনা, নিজে নিজেই জেনে যাবেন কি কি লাগবে।

“ভাইয়া আমি অমুক ভার্সিটিতে পড়তে চাই, কি করব বলেন”– এইরকম জেনারালাইজড প্রশ্ন করাটা হচ্ছে সময় নষ্ট কারণ এত দীর্ঘ একটা পদ্ধতি এক বসায় কাউকে স্টেপ বাই স্টেপ বোঝানোর মত সময় বেশিরভাগ মানুষেরই থাকেনা। এছাড়া চামচ দিয়ে মুখে তুলে কেউ আপনাকে খাইয়ে দেবে এটা আশা করাটাও খুব অন্যায়। তার চাইতেও জরুরী ব্যাপার হচ্ছে, দায়টা আপনার, অন্য কেউ এই দায় আদায় করতে পারবেনা। পরনির্ভরশীলতা এবং অন্যের মুখের দিকে চেয়ে থাকার এই বদভ্যাস পরিহার করুন, স্বাবলম্বী হতে শিখুন। আপনি অন্য কারও চাইতে কম নন। আজকে যে এমআইটি তে পিএইচডি করেছে, একদিন সেও এই আপনার মতই একা একা বসে ঘাঁটাঘাটি করেছে, সময় দিয়েছে। শর্টকাটে কোনওকিছু পাবার অন্যায় আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে থাকুন।

এই বেলা বলে রাখি, র‍্যাংকিং বা ব্রান্ড নেইম কিন্তু খুব দুর্বল একটা ইনডিকেটর। একটা উদাহরণ দেইঃ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল, বিজনেস বা আইনের জন্য বিশ্ববিখ্যাত, কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য পড়তে আপনি হার্ভার্ড আসলে সেটা খুব একটা স্মার্ট ডিসিশন হবে না। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে আপনি যাবেন অক্সফোর্ডে, যেটা আমেরিকার বাইরে। আবার আপনি যে স্পেসিফিক বিষয়ে রিসার্চ করছেন দেখা যাচ্ছে সেই বিষয়ে সবচাইতে ভালো কাজ হচ্ছে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যার র‍্যাংকিং দুইশ এর বাইরে- সেক্ষেত্রে আপনার ওখানেই চেষ্টা করা উচিত। ওভারঅল বা সামগ্রিক র‍্যাংকিং(ইউএস নিউজ, টাইমস হায়ার এডুকেশন, কিউ এস র‍্যাংকিং ইত্যাদি) এর উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়াটা বড় ধরণের বোকামি। আপনাকে দেখতে হবে ডিপার্টমেন্ট এর র‍্যাংকিং, আরও গভীরে গিয়ে দেখতে হলে প্রফেসর এর কাজের ধরণ ইত্যাদি।

উপরে যেভাবে দেখালাম, প্রতিদিন এভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করুন বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট, দেখবেন নিজেই অনেক কিছু জেনে যাচ্ছেন, সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে যাচ্ছে। আরও জরুরী একটা বিষয় হচ্ছে, আপনার নিজের অবস্থান এবং পারিপার্শ্বিকতা মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিন কোথায় কোথায় এ্যাপ্লাই করবেন। বিশ্বের টপ যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এগুলোতে মাঝারি বা নিম্ন-মাঝারি প্রোফাইল নিয়ে এপ্লাই না করাই ভালো। অন্ততঃ এমন একটা বা দুটো দিক আপনার থাকতে হবে যেটা আপনাকে বিশ্বের সব দেশের ছাত্রছাত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতা করার মত পর্যায়ে রাখবে। সেরকম কিছু আপনার প্রোফাইলে থাকলে নির্দ্বিধায় এপ্লাই করুন (আমার ক্ষেত্রে এটা ছিল আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সঙ্কটে মায়ানমার বর্ডারে সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা, কেউ হয়ত বিশ্বের সেরা কোনও জার্নালে প্রবন্ধ ছাপিয়েছেন, কারো হয়ত পারফেক্ট সিজিপিএ আর জিআরই স্কোর ইত্যাদি) । যদি মনে করেন সেরকম কিছু এই মুহূর্তে আপনার নেই, তাহলে মাঝারি সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এপ্লাই করুন এবং সেখানে খুব ভালো কাজ দেখিয়ে পরবর্তীতে চেষ্টা করুন টপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

বিশ্বসেরা কাজ করতে হলে সব সময় যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়েই যেতে হবে এমন কোনও কথা নেই। দিনশেষে কাজটাই আসল, কোথেকে করলেন সেটা না।


দ্বিতীয় ধাপঃ জিআরই এবং আইইএলটিএস প্রস্তুতি

প্রস্তুতির প্রথম ধাপ আপনি ইতোমধ্যে নিয়ে নিয়েছেন( এবং নিচ্ছেন) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে জিআরই প্রস্তুতি। জিআরই বা গ্রাজুয়েট রেকর্ড এগজামিনেশন হচ্ছে একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্ট যেটা আপনার ইংরেজি বোঝার ক্ষমতা, বেসিক ম্যাথ সমাধানের দক্ষতা আর এনালাইটিকাল ইংলিশ লেখার দক্ষতা যাচাই করে।

জিআরই পরীক্ষা নিয়ে অকারণ ভীতি দেখতে পাই এমনকি ভাল ছাত্রদের মধ্যেও। স্রেফ জিআরই দেবার ভয়ে বহু মানুষ আমেরিকায় এপ্লাই করেন না। সবিনয়ে বলি, জিআরই এমন কোনও হাতি ঘোড়া পরীক্ষা না যে এইটা নিয়ে ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকতে হবে।ক্লাস এইটের সমমানের গণিত থাকে এখানে( স্ট্যাট আর প্রোবাবিলিটি কলেজ লেভেলের, অনুশীলন করে পারা যায়না এমন কিছু না), চ্যালেঞ্জটা থাকে অনুশীলন করে অল্প সময়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়ায়।নেটে ফ্রি যেসব রিসোর্স আছে এগুলো ব্যবহার করেই মাস খানেকের মধ্যেই ম্যাথে ভালো স্কোর তোলা সম্ভব। নন-স্টেম বিষয়ে যারা আছেন তাদের জন্য জিআরই স্কোর অতি উচ্চ হতে হবে এটাও কোনও কথা না। তিনশ প্লাস স্কোর দিয়েও ফুল ফান্ডিং সহ এ্যাডমিশন পাওয়া যায় বিশ্বের সেরা স্কুলগুলোতে। আর মাস তিনেক খাটাখাটি করলে টপ স্কোর তোলাও অসম্ভব না একজন সাধারণ ছাত্রের জন্যেও। আমার স্কোর আহামরি না- ৩০৯( ম্যাথ ১৫১, ভার্বাল ১৫৮, রাইটিং সাড়ে ৪)। এই স্কোর নিয়েও দুটো আইভি লীগে (কলম্বিয়া, হার্ভার্ড) ফান্ডিং ছাড়া আর একটা নন-আইভি লীগে (জর্জটাউন, সিকিউরিটি স্টাডিজ ফিল্ডে আইভি লীগ এবং নন-আইভিলীগ মিলিয়ে আমেরিকার সেরা স্কুল) ফুল ফান্ডিং সহ এ্যাডমিশন পেতে কোনও অসুবিধা হয়নাই।জিআরই আমেরিকার এ্যাডমিশন প্রসেসের প্রাণভোমরা না, আরও দশটা ফ্যাক্টরের একটা মাত্র।

সবাইকে বিনয়ের সাথে বলি, আগে “জিআরই খুব কঠিন” এই এ্যাটিটুড টা ভাঙুন প্লিজ। জিআরই মেধার পরীক্ষা না, এটা অনুশীলনের পরীক্ষা। যে যত প্রাকটিস করবে, সে তত ভাল করবে। নীলক্ষেত থেকে  জিআরই অফিসিয়াল গাইড আর ম্যানহাটন ফাইভ পাউন্ড এই দুটো কিনে বুঝে বুঝে সমাধান করলে আর বেশি কিছু লাগেনা। ক্রাঞ্চপ্রেপ (Crunch Prep) নামে একটা ভারতীয় সাইট আছে যেটায় খুব ভাল কিছু আর্টিকেল আছে, কিভাবে অনলাইনে তেত্রিশটা ফ্রি টেস্ট দেয়া যায় সেটাও আছে( গুগল করুন 33 Free GRE tests Online)। এছাড়া মাগুশ(Magoosh) নামে একটা ওয়েবসাইট আছে ওটার ম্যাটেরিয়ালস খুবই উন্নত মানের, এটা সাবস্ক্রাইব করে( ছয় মাসের জন্য দাম প্রায় দেড়শ ডলার, একা না কিনে কয়েকজন মিলে কিনলে খরচ কম পড়বে) ম্যাটেরিয়ালগুলো অনুশীলন করতে পারেন। মাগুশ ছাড়া বহু মানুষ জিআরই তে অতি উচ্চ স্কোর করেছে, যদি খরচে না পোষায় প্রয়োজন নেই।

অহেতুক জিআরই ভীতি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন প্লিজ!

এবার আসি আইইএলটিএস(International English Language Testing System) এ। আমেরিকার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ল্যাংগুয়েজ টেস্ট হিসেবে টোফেল বা এইটা চায়। আমি টোফেল দেইনি, আইইএলটিএস দিয়েছি।যদিও ওটা লাগেনাই কারণ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়াম অফ ইন্সট্রাকশন ছিল ইংলিশ। আইইএলটিএস ইংরেজিতে শোনা, কথা বলা, লেখা আর পড়ার দক্ষতা যাচাই এর পরীক্ষা। এই লেখাটা পড়লে আপনি ইংরেজিতে দক্ষ হবার পদ্ধতি সম্পর্কে আইডিয়া পাবেনঃ

 

আইইএলটিএস এর ম্যাটেরিয়াল হিসেবে আমি কেমব্রিজের বইগুলি  আর ইউটিউবে ফ্রি ভিডিওগুলো ব্যবহার করেছি( হাজার হাজার আছে)।

তৃতীয় ধাপঃ স্টেটমেন্ট অফ পারপাসঃ

 

আপনার এ্যাপ্লিকেশনের প্রাণভ্রোমরা হচ্ছে SOP. এইটা যদি শক্ত না হয়, বাকি সব কিছু পারফেক্ট হলেও এ্যাডমিশনের সম্ভাবনা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে।সাধারণত আধা পৃষ্ঠা থেকে দেড় পৃষ্ঠার বেশি হয়না এটা( যত ছোট হয় ততই ভালো)। যেখানে আপনি পড়তে চান সেখানে কেন পড়তে চান, কোন টপিক পড়তে চান, আপনার অতীত অভিজ্ঞতা কিভাবে এখানে পড়তে আপনাকে সহায়তা করবে এবং কেন এখন,এই জায়গাতেই আপনি পড়তে চান এগুলো সংক্ষেপে গুছিয়ে একটা সামগ্রিক গল্পের নামই হচ্ছে স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ।

স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ লিখবেন কিভাবেঃ

একটা কাগজ নিয়ে বসুন, হাতে কলম। এবার নীচের প্রশ্নগুলোর উত্তর চিন্তা করুনঃ

কেন আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগে এই স্পেসিফিক প্রোগ্রামে ভর্তি হতে চান?

এই প্রশ্নের উত্তরে যা যা লিখলে ধরা খাবেন সেগুলো বলিঃ

“It was my childhood dream to study at MIT”

ভাই, নোবডি কেয়ারস এবাউট ইয়োর চাইল্ডহুড ড্রিম। আপনার একাডেমিক ইন্টারেস্ট কি এবং কিভাবে সেটা এই বিভাগের সাথে ম্যাচ করে ওরা এটা জানতে চায়। সারাজীবন পড়ে এসেছেন ফিজিক্স কিন্তু এখন ভর্তি হতে চাচ্ছেন বিজনেস স্কুলের এমবিএ তে- কেন এই পরিবর্তন এটার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা আপনাকে দিতে হবে।হয়ত ফিজিক্সের পাশাপাশি আপনি একটা স্টারট আপ কোম্পানি খুলেছিলেন বা দারুণ কিছু বিজনেস প্ল্যান ছিল আপনার যেটা আপনি বাস্তবায়ন করতে চান-এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে কাজ হয়েছে আগে, এক দুজন প্রফেসর আছেন এই কাজের জন্য বিখ্যাত। এগুলো লিখবেন ওখানে, হাবিজাবি কথাবার্তা না।

“I want to study at University of Toronto because it is the best university of Canada”

ও ভাই, এ্যাডমিশন কমিটি জানে এইটা, আপনাকে নতুন করে বলার প্রয়োজন নাই মোটেও। ওরা জানতে চায় একেবারে পিনপয়েন্ট উত্তর। “আমার রিসার্চ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অমুক টপিকে, এই টপিকের সেরা প্রফেসর ডক্টর ইশতিয়াক এখানে পড়ান।আমি চাই উনার অধীনে বা উনার কাছাকাছি থেকে আমার রিসার্চটাকে একটা বিশ্বমানের কাজে নিয়ে যেতে, যে কাজ করলে মানুষের অমুক উপকার হবে”- এটা হচ্ছে একটা ভালো রিপ্লাইয়ের উদাহরণ।

“Gandhi said, in gentle ways we shake the world. I want to be future Gandhi so I want to study peace and conflict studies in Harvard Kennedy School”

ও ভাইজান, এই স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ গান্ধিজীর না,আপনার। এইটা আপনাকে দেয়া হয়েছে একেবারেই আপনার নিজের কথা বলার জন্য, গান্ধীজীর উক্তি লিখে জায়গা নষ্ট করার জন্য না।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমার এসওপি ছিল মাত্র আধা পৃষ্ঠা। ওদের সিকিউরিটি স্টাডিজ মাস্টার্সের এসওপিতে আমি লিখেছিলাম- আমি বাংলাদেশ পুলিশের একজন কর্মকর্তা যে কিনা রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময় মায়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে কাজ করেছে। আমি মনে করি, নতুন রোহিঙ্গা আগমনের ফলে দেশের পুরোন সন্ত্রাসবাদীরা এদের সাথে যোগ দিয়ে গোটা অঞ্চল অস্থিতিশীল করে দিতে পারে এরকম একটা আশঙ্কা রয়েছে। পুলিশের ভেতর থেকে এ ব্যাপারে এখনও কোনও পেশাদার একাডেমিক রিসার্চ হয়নি এটা নিয়ে।এই যে সম্ভাব্য বিপদ এবং তার প্রতিকার-এটা নিয়ে কাজ করার মত ফিল্ড এক্সপেরিয়েন্স আমার আছে,আর জর্জটাউনের আছে বিশ্বসেরা সব এক্সপার্ট। কাজেই, আমি এলে এমন একটা কাজ হতে পারে যার মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ না,বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও শরনার্থী সংকটে কাজে লাগে এমন সমাধান পাওয়া যাবে।

স্রেফ এটুকু লিখে জর্জটাউনে শুধু এ্যাডমিশন নয়,ফুল ফান্ডিংও পেয়েছিলাম।

ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন।

একজন পুলিশ অফিসার যার সাত বছরের অভিজ্ঞতা আছে সার্ভিসে, যে সরাসরি রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময় কাজ করেছে ওখানে, সে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে একাডেমিক কাজ করতে চাইছে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটার সবচেয়ে নাম করা ডিপার্টমেন্ট হচ্ছে সিকিউরিটি স্টাডিজ। সে রোহিঙ্গা সঙ্কটের পুরোটা নয়, ওখানের রোহিঙ্গা-সন্ত্রাসী সম্ভাব্য যোগাযোগ নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছে। এই গবেষণা করতে পারলে বাস্তবে সেটা কাজে লাগানোর জায়গাও আছে।

আমার গল্পটা কি মেইক সেন্স করে? বোঝা যাচ্ছে?

ঠিক এইভাবে চেষ্টা করুন আপনার গল্পটাকে সাজাতে। ইট মাস্ট মেইক সেন্স।

কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলেন না?

একে একে লাইন টেনে লিখুন নীচের প্রশ্নের উত্তরঃ

কি পড়তে চাই(খুব স্পেসিফিক টপিক, যত পিন পয়েন্ট করা যায় তত ভালো)

এটা পড়ে কি হবে? কোন কাজে লাগবে এই পড়াশোনা?

কেন আমার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগেই পড়তে হবে? এখানে কি এমন আছে যা অন্য কোথাও নেই?

আমাকে নিলে এই বিশ্ববিদ্যালয় কি পাবে আমার কাছ থেকে? আমার কি এমন কোনও কাজ বা অভিজ্ঞতা আছে যা ক্লাসরূমে আলোচনায় ভিন্ন মাত্রা যোগাবে?

স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ বাজে গালগল্প করার জায়গা না।অনেক চিন্তা করে, পাঁচ দশ বার ড্রাফট করে, অসংখ্যবার এডিট করে তৈরি হয় একটা স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ। এ্যাডমিশন কমিটি পড়লেই বুঝতে পারে এটা ফালতু নাকি যত্ন নিয়ে লেখা।একেক ফিল্ডে এসওপি একেক রকম হয়, কাজেই যিনি সায়েন্সে পড়ছেন তার উচিত একই বিষয়ে পড়ছে এমন কাউকে দিয়ে চেক করানো। তবে মূল কথাগুলো মোটামুটি একই।প্রথম ড্রাফট ভালো হবেনা জানা কথা। নিজে এডিট করুন, অভিজ্ঞদের দিয়ে এডিট করান। এডিট করানো মানে আবার তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়া না এইটা মাথায় রাখবেন।

চতুর্থ ধাপঃ লেটার অফ রেকমেন্ডেশনঃ 

আমেরিকার এ্যাডমিশনের ক্ষেত্রে স্টেটমেন্ট অফ পারপাজের সমপরিমাণ বা কখনো কখনো তার চাইতে বেশি গুরুত্ব বহন করে সেটা হচ্ছে এই রেকমেন্ডেশন লেটার।আপনি ছাত্র হিসেবে কেমন,পেশাগত জীবনে কেমন,ভবিষ্যতে আপনার গবেষণা বা পড়াশোনায় সফল হবার সম্ভাবনা কতটুকু,আপনার ভেতরে এমন কোনও গুণ আছে কিনা যা আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করেছেন সেটার সাথে খুব ভালোভাবে খাপ খায়- এই জিনিসগুলো বর্ণিত হয় রেকমেন্ডেশন লেটারে।

কিভাবে রেকমেন্ডার সিলেক্ট করবেন?

একেক প্রোগ্রামে একেক ভাবে রেকমেন্ডার চেয়ে থাকে। আমার প্রোগ্রামে রেকমেন্ডার চেয়েছিল তিন জন,এদের মধ্যে দুজন প্রফেশনাল এবং একজন একাডেমিক। আপনি এমন মানুষদের রেকমেন্ডার হিসেবে সিলেক্ট করবেন যারা এক) আপনাকে ভালোভাবে চেনে দুই) আপনার সাথে প্রফেশনাল বা একাডেমিক পর্যায়ে সুপারভাইজ করেছেন এবং তিন) আপনার সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন।

একটা প্রচলিত ভুল ধারণা হচ্ছে,বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হলে খুব বড় বড় নামকরা মানুষের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার নিতে হবে।হার্ভার্ডে এপ্লাই করার সময় আমার ধারণা ছিল প্রফেসর ইউনুস,স্যার ফজলে হাসান আবেদ বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী- এই পর্যায়ের কারো কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন না নিলে জীবনেও চান্স পাওয়া যাবেনা।মুশকিল হচ্ছে,এই পর্যায়ের কাউকে আমি সরাসরি ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিনি না,তাঁদের কারো সাথে আমি প্রফেশনালি কাজ করিনি। কাজেই,এঁদের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার পাবার সম্ভাবনা শূন্য।

কি করা যায়?ঠিক করলাম যা আছে কপালে- আমি এমন সব মানুষের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন নেবো যারা আসলেই আমাকে ভালোভাবে চেনেন,আমার সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। হার্ভার্ডে আমার রেকমেন্ডার হিসেবে নির্বাচন করলাম তিনজনঃ

এক) আমার আন্ডারগ্রাড রিসার্চ সুপারভাইজর (নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়)
দুই) পুলিশ সুপার বান্দরবান ( আমি যাঁর অধীনে সরাসরি কাজ করতাম)
তিন) পুলিশ সুপার,স্পেশাল ব্রাঞ্চ ( এই স্যারের অধীনে স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটি কোর্সে আমি প্রথম হয়েছিলাম)

এঁরা কেউ নোবেল বিজয়ী বা নাইটহুড প্রাপ্ত নন,কিন্তু আমাকে ভালভাবে চেনেন। অনুরোধ করতেই সানন্দে রাজি হলেন।

এটা ঠিক,বিখ্যাত কেউ যদি আপনার সরাসরি প্রফেশনাল বা একাডেমিক পর্যায়ে পরিচিত থাকে এবং আপনাকে ভালোভাবে চেনে- তাঁদের রেকমেন্ডেশন আপনার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু যদি তা না হয়- শুধু নামের উপর ভিত্তি করে একে ওকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে যদি আপনি রেকমেন্ডেশন যোগাড়ও করে থাকেন- এবং সেই রেকমেন্ডেশন যদি দায়সারা হয়- সেটা বিশ্ববিখ্যাত কেউ দিলেও আপনার এ্যাডমিশনে খুব একটা সহায়তা করবেনা।

 

একটা ভালো রেকমেন্ডেশন লেটারের কিছু বৈশিষ্ট্য আছেঃ

ক) এটা হতে হবে এমন কারো কাছ থেকে যে সরাসরি চাকুরীতে বা একাডেমিকালি আপনাকে সুপারভাইজ করেছে

খ) আপনার যে গুণটি তিনি বর্ণনা করবেন- এই বর্ণনা দায়সারা হবেনা,এতে বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।ধরা যাক,সাকিব আল হাসান এমআইটির ক্রিকেট স্টাডিজ বিভাগে মাস্টার্সের জন্য আবেদন করেছেন।তিনি যখন রেকমেন্ডেশন নিতে যাবেন- তখন রেকমেন্ডেশন লেটারে দু ধরণের বর্ণনা হতে পারে।

দায়সারা বর্ণনাঃ  “সাকিব আল হাসান খুব ভালো ক্রিকেটার”

ভাল বর্ণনাঃ “সাকিবআল হাসান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারদের একজন,বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সে-ই বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার হবার গৌরব অর্জন করেছে। ওর বাঁহাতি স্পিন বোলিং এবং মিডল অর্ডার ব্যাটিং বাংলাদেশ দলের জন্য অমূল্য সম্পদ। দলের প্রয়োজনে সে কঠোর পরিশ্রম করে এবং নিজের সর্বোচ্চটা দেবার চেষ্টা করে।অস্ট্রেলিয়ার সাথে ওয়ানডে ম্যাচে একশ চার ডিগ্রি জ্বর নিয়েও সে মাঠে নেমেছে এবং হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে জিতিয়েছে- যেটা তার দলের প্রতি আনুগত্য,একাগ্রতা এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞার পরিচয় বহন করে। ওর সাবেক কোচ হিসেবে আমি মনে করি,এরকম একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে কাজ করলে এমআইটি ক্রিকেট স্টাডিজ বিভাগ যেমন উপকৃত হবে,একইভাবে সাকিবও এমআইটির গবেষণা থেকে নিজেকে ঋদ্ধ করে আরও ভালভাবে বিশ্ব ক্রিকেটে অবদান রাখতে পারবে”।

আপনার রেকমেন্ডেশন যিনি দেবেন,তাঁর সাথে বার বার দেখা করে এই বিষয়গুলো ভালোভাবে আলোচনা করে নিশ্চিত হয়ে নেবেন যেন রেকমেন্ডেশনের বর্ণনা দ্বিতীয়টির মত হয়। যেহেতু এটা কনফিডেনশিয়াল এবং ছাত্রের জানার কথা না- কাজেই যেসব রেকমেন্ডারের প্রতি আপনার পূর্ণ আস্থা আছে যে তিনি উল্টাপাল্টা কিছু লিখবেন না- এমন লোকদেরকে নির্বাচন করবেন রেকমেন্ডেশনের জন্য।রেকমেন্ডেশন জোগাড়ের কাজটা শুরু করবেন অন্ততঃ মাস খানেক সময় হাতে রেখে- রেকমেন্ডেশন লেটার যদি ডেডলাইনের  ভেতরে না পৌঁছে,সেক্ষেত্রে আপনার সব পরিশ্রম জলে যাবার সম্ভাবনা আছে। অতএব,সাধু সাবধান!

পঞ্চম ধাপঃ ফান্ডিং 

ফান্ডিং ছাড়া আমেরিকাতে সম্পূর্ণ নিজ খরচে মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে যাওয়াটা অসম্ভবের কাছাকাছি একটা কাজ। আপনি যদি এ্যাডমিশন পানও, ফান্ডিং ছাড়া একজন সাধারণ পরিবারের ছাত্রের পক্ষে সেখানে পড়াটা দুঃসাধ্য। মাস্টার্স পর্যায়ে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য ফুল-ফান্ডিং পাওয়াটা খুব কঠিন, বিশেষ করে সেটা যদি নন-টেকনিকাল বিষয়ে হয়। তবে  সাধারণতঃ পিএইচডিতে ফান্ডিং পাওয়া যায়।

আপনার এ্যাডমিশন যদি কোনও ড্রিম স্কুলে হয় ( হার্ভার্ড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড ইত্যাদি টপ স্কুল অথবা যে স্কুলে যাওয়া আপনার স্বপ্ন), সেক্ষেত্রে ফান্ডিং না পেলেও স্টুডেন্ট লোনের মাধ্যমে আপনি এসব জায়গায় পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে cost-benefit analysis করতে হবে নিজে নিজে, যে খরচ আপনি করবেন সেটা আপনি কত বছরে তুলে আনবেন এটা নিয়ে চিন্তা করুন। আমার ফান্ডিং ছিলোনা, আমি নির্ভর করেছি হার্ভার্ডের নিজস্ব লোন(Harvard University Employees Credit Union) এবং পারিবারিক লোনের উপর। এছাড়া হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের একটা মজার সিস্টেম আছে, এখানকার ছাত্ররা লোন নিয়ে পড়তে এসে পড়াশোনা শেষ করে পাবলিক সেক্টরে কাজ করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত হার্ভার্ড সেই লোন শোধ করে। একটু বুঝেশুনে লোন নিলে খরচ সিংহভাগই কমিয়ে আনা যায়। প্রডিজি ফিনান্স নামে  একটা প্রতিষ্ঠান আছে যারা এই টপ স্কুলগুলোতে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের লোন দেয়। এছাড়া আগা খান স্কলারশিপ আছে, খাজানাহ স্কলারশিপ আছে, রোটারি স্কলারশিপ আছে – এরাও টপ স্কুলে চান্স পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের ফান্ডিং দেয়। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য প্রাইম মিনিস্টার্স স্কলারশিপ আছে, সরকারী চাকুরীজীবীদের জন্য স্ট্রেংদেনিং প্রোগ্রামে এক বছরে প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা স্কলারশিপের ব্যবস্থা আছে।

আমি তিনটা স্কুলে এপ্লাই করেছিলামঃ হার্ভার্ড, কলম্বিয়া আর জর্জটাউন।

এর মধ্যে হার্ভার্ড আর কলম্বিয়াতে এ্যাডমিশন হলেও ফান্ডিং হয়নি, জর্জটাউনে ফুল ফান্ডিং হয়েছিল। আমি হার্ভার্ডে এসেছি নিজস্ব হিসাবনিকাশ চিন্তাভাবনা করে, আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তাঁরা হয়ত জর্জটাউন বেছে নিতেন, কেউ হয়ত বেছে নিতেন কলম্বিয়া।

ফান্ডিং প্রসেসটা একেক স্কুলে একেক রকম।

জর্জটাউন আর কলম্বিয়াতে ফান্ডিং এর জন্য আলাদা ভাবে এপ্লাই করতে হয়নি, এ্যাডমিশনের জন্য যে এ্যাপ্লিকেশন ওটার উপর ভিত্তি করেই ফান্ডিং ডিসিশন এসেছে। হার্ভার্ডে ফান্ডিং এর জন্য আলাদাভাবে এপ্লাই করতে হয়েছে। সাধারণতঃ আলাদা একটা রচনা লেখা লাগে, সাথে একটা বা দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।

একজন ছাত্রের উচিত সবার আগে এ্যাডমিশন নিয়ে মাথা ঘামানো, কারণ যদি এ্যাডমিশন ম্যাটেরিয়ালস খুব ভালো হয় ফান্ডিং পাবার সম্ভাবনা অটোমেটিকালি বেড়ে যায়। অনার্সে ভাল সিজিপিএ, ভাল জিআরই স্কোর, পাবলিকেশন, দুর্দান্ত স্টেটমেন্ট অফ পারপাস ইত্যাদি সব মিলিয়ে ক্যান্ডিডেট যদি খুব শক্ত ক্যান্ডিডেট হয়, ফান্ডিং আসতে বাধ্য।

“আমার সম্ভাবনা কতটুকু?” 

হায়ার স্টাডি গ্রুপগুলোতে অনেকগুলো পোস্ট দেখছি এরকমঃ

“আমার সিজিপিএ এত কম/বেশি, জিআরই স্কোর এত, আমি আন্ডারগ্রাড দেশে করেছি অমুক বিষয়ে- আমার এ্যডমিশন আর ফান্ডিং এর সম্ভাবনা কতটুকু?”

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পৃথিবীর কেউ বলতে পারবেনা আপনার সম্ভাবনা আসলে কতটুকু শুধুমাত্র যেখানে আবেদন করছেন সেখানের এ্যাডমিশন কমিটি ছাড়া।

এ্যাডমিশন প্রসেস (মাস্টার্স লেভেলে) একটা রংধনুর মত,যেটার সৃষ্টি হয় সাতটা ভিন্ন ভিন্ন রঙের সমন্বয়ে।

এক) স্টেটমেন্ট অফ পারপাস
দুই) আন্ডারগ্রাড সিজিপিএ
তিন) রেকমেন্ডেশন লেটার
চার) চাকুরির পূর্ব অভিজ্ঞতা
পাঁচ) রিসার্চের অভিজ্ঞতা/পাবলিকেশন
ছয়) এ্যাডমিশন Essay
সাত) GRE/GMAT/IELTS ইত্যাদি স্কোর

সব স্কুলে যে উপরের সব কিছুই চাইবে এমন নয় (যেমন অনেক স্কুলে চার, পাঁচ, সাত চায় না)।

এই যে সাতটা রঙ, সবার কি এই রঙ একেবারে সূর্যের মত উজ্জ্বল? মোটেই না । কারো দুই উজ্জ্বল কিন্তু পাঁচ অত উজ্জ্বল না, কারো হয়ত সাত খুব ভাল কিন্তু দুই অত ভাল না।

একজন প্রার্থী হিসেবে আপনার প্রচেষ্টা হওয়া উচিত কিভাবে আপনি আপনার রঙধনূকে কতটা উজ্জ্বল করতে পারেন। যত উজ্জ্বল তত বেশি সম্ভাবনা, তবে নিশ্চয়তা নেই কোনও।

যেটা আপনার হাতে নেই,সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে প্রস্তুতি নেয়াটাই সমীচীন।

আরেকটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ওই স্কুলের সাথে আপনি ম্যাচ করেন কিনা। আপনি যত তুখোড়ই হোন না কেন, যদি আপনার সাথে স্কুল ম্যাচ না করে সেক্ষেত্রে এ্যাডমিশনের সম্ভাবনা খুব কম। আপনি সারাজীবন বিজনেস পড়েছেন কিন্তু এপ্লাই করেছেন পাবলিক হেলথ স্কুলে- এক্ষেত্রে আপনাকে অতি অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে কিভাবে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড এই স্কুলের সাথে ম্যাচ করে।

এক আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষে বলা সম্ভব না আপনি অমুক প্রোফাইল নিয়ে তমুক স্কুলে চান্স পাবেন কিনা। কাজেই, এটার পেছনে বেশি সময় না দিয়ে নিজের প্রোফাইল ঘষামাজা করুন।

ষষ্ঠ ধাপঃ ভিসা

শুনলে হয়ত হাসবেন, এই গোটা প্রক্রিয়াতে আমি সবচেয়ে বেশি নার্ভাস ছিলাম ভিসা নিয়ে। একে তো সেলফ ফান্ডিং নিয়ে পড়তে যাচ্ছি, তারপরে পুলিশ অফিসার হিসেবে আমার পুরোদস্তুর আর্মস এন্ড এ্যামিউনিশন হ্যান্ডেলিং এর ট্রেনিং আছে। এই যে মাসের পর মাস প্রস্তুতি, এত স্বপ্ন, এত পরিশ্রম- এর সবকিছু একজন ভিসা অফিসার কলমের এক খোঁচায় মাতিতে মিশিয়ে দিতে পারেন।

ভিসা প্রসেস নিয়ে বাংলাদেশে আমেরিকার দূতাবাসের ওয়েবসাইটেই বিস্তারিত আছে, আমি অতি সংক্ষেপে কিছুটা বলছি। ভিসা অফিসার যাচাই করবেন তিনটা জিনিসঃ

এক) আপনার আমেরিকা থেকে ফেরত আসার সম্ভাবনা কতটুকু।যদি বুঝতে পারে যে আপনি ওখানে থেকে যাবার ধান্ধায় আছেন- সাথে সাথে খোদা হাফেজ।

দুই) যেখানে পড়তে যাচ্ছেন সেখানে এক বছর থাকা খাওয়ার খরচ আপনি কিভাবে দেবেন। যদি স্কলারশিপ হয় তাহলে তো দারুণ, স্কলারশিপ না হলে কিভাবে সেলফ ফান্ড করবেন সেটার বিস্তারিত বর্ণনা( কাগজপত্র সহ)।

তিন) যা যা বলছেন সেগুলোর যৌক্তিক ভিত্তি আছে কিনা।

ভিসা নিয়ে অনেক ভীতিকর কথাবার্তা শোনা যায়, বিশেষ করে ইন্টারনেটে ঘাঁটলে রীতিমত আতঙ্ক লাগে। আমার ভিসা ছয়দিন এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রসিডিউরে ছিল, এই ছয়টা দিন নরক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গিয়েছি। পঞ্চম দিনে মরীয়া হয়ে হার্ভার্ডের অফিসিয়াল ইমেইল এ্যাড্রেস থেকে ওদের ইমেইল করে বলেছিলাম, যদি সেলফ ফান্ডিং এর কারণে তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো যে আমাকে ভিসা দিচ্ছ না সেক্ষেত্রে দ্রুত আমাকে জানাও যেন আমি জর্জটাউনের ফুল ফান্ডিং অফার নিয়ে আবার এপ্লাই করতে পারি। সেটা  করা লাগেনাই, পরের দিনই ভিসা এ্যাপ্রুভ করেছিলো।

এই যে লিখছি, ওই ছয়দিনের কথা মনে হলে এখনও আতঙ্ক লাগে। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমার দেশ এতই  শক্তিশালী হবে যে আর কোনও বাংলাদেশি নাগরিককে এই আতঙ্কময় প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে হবেনা।

শেষের কথাঃ 

এ লেখাটি যদি আপনার সামান্য কাজে লেগে থাকে তাহলে আপনার জন্য একটা ছোট অনুরোধ আছে। যদি মনে করেন লেখাটা অন্য কারো কাজে আসবে, তাকে পড়তে দিন। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়তে যেতে পারেনা যোগ্যতার অভাবে না, সঠিক তথ্য আর প্রস্তুতির অভাবে।

বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা বিশ্বের শ্রেষ্ট বিদ্যাপীঠগুলো দাপিয়ে বেড়াবে, তারপর অর্জিত জ্ঞান দেশে প্রয়োগ করে বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবে, বাংলা মায়ের এক সামান্য সন্তান হিসেবে এটাই আমার প্রত্যাশা।

সীমাবদ্ধতাঃ

এই লেখায় পিএইচডি এ্যাডমিশন পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই নেই কারণ আমি পিএইচডি এ্যাডমিশন সম্পর্কে জানি না। কিভাবে প্রফেসরকে মেইল করবেন, বিষয় নির্বাচন করবেন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে শ্রদ্ধেয় বড়ভাই ডক্টর রাগিব হাসানের “গবেষণায় হাতেখড়ি” বইটই পড়ুন, ফেসবুকে উনার ওয়ালে লেকচারগুলো দেখুন।

#ভিডিওঃ

এক) বাইরে পড়তে যাওয়া বিষয়ক সাক্ষাতকারঃ

দুই) অক্সফোর্ডের শামির মোনতাজিদ এর সাথে এ্যাডমিশন বিষয়ক আলাপচারিতাঃ

Comments

comments