এক: বাকির আশায় নগদ ছাড়বেন না।সুদূর পরাহত সম্ভাবনার আশায় নিশ্চিত প্রাপ্তি ছেড়ে দেয়াটা মূর্খতা।
আমরা বাংলাদেশীরা “ভবিষ্যতে ব্যবসা করে মাসে মাসে লভ্যাংশ দেবে”- এই আশায় নিজের সঞ্চিত টাকাপয়সা অর্ধপরিচিত উটকো লোকজনের মিষ্টি কথায় ভুলে কে কে দিয়ে দিয়েছি, হাত তুলুন তো!!
দুই: বিষ থেকে মধু বের করে নিন, কাদামাটি ধুয়ে স্বর্ণ আহরণ করুন। সমাজের নীচের দিকে থাকা লোকের কাছ থেকেও জ্ঞান আহরণ করুন, গুনী মেয়ের জাতপাত বিচার না করে তাকেই ঘরে তুলুন।
মৃতদেহের সুরতহাল কিভাবে করতে হয়, গ্রামদেশে প্রচন্ড রক্ষণশীল পরিবেশেও কিভাবে নিজের পুলিশি তল্লাশী ঠিকই করে নেয়া যায়- আমাকে সবচেয়ে ভালোভাবে হাতে ধরে শিখিয়েছিল দামুড়হুদা থানার এস আই ফারুক, যে কিনা কন্সটেবল থেকে ধাপে ধাপে উপরে উঠেছে। জ্ঞানের রাস্তায় কোন এলিট-নন এলিট নেই, যেখানে পান আহরণ করে নিন!
তিন: সত্যিকারের সন্তান তার পিতামাতার প্রতি বাধ্যগত, সত্যিকারের বন্ধুর কাছে গোপন কথা বলা যায়, সত্যিকারের জীবনসঙ্গিনীর সান্নিধ্যে তার সঙ্গী তৃপ্তি এবং প্রশান্তি লাভ করে।
খেয়াল করুন,এখানে সঙ্গী/সঙ্গিনীর রূপ-গুণ, টাকাপয়সা এমনকী জ্ঞানের কথাও বলা হয়নি। হার্ভার্ড পিএইচডিধারী সঙ্গী যদি আপনাকে মানসিক প্রশান্তি এবং পরিতৃপ্তি দিতে নয়া পারে, ওই সঙ্গীর সান্নিধ্য মোটেই কাম্য নয়।
চার: আপনার সামনে মিষ্টি কথা বলা আর পেছনে কটু কথা বলা লোকটা দুধের সাথে মেশানো বিষের শিশির মতই বিপজ্জনক।
পাঁচ: খারাপ সঙ্গীকে বিশ্বাস করবেন না, স্বল্প-পরিচিত বন্ধুকে বিশ্বাস করে গোপন কথা বলবেন না। আপনার উপর রাগ হওয়ামাত্রই সে গোপন কথা আপনার শত্রুকে বলে দেবে।
ছয়: নিজের উদ্দেশ্য কখনো সরাসরি বলে দেবেন না। যা করতে চান তা গোপন রাখুন, চুপেসারে কাজ করে ফেলুন, সঠিক সময়ে আঘাত হানুন।
সাত: যে পিতামাতা সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেনা সে পিতামাতা আসলে সন্তানের শত্রু।
জ্বি, এটাই বাস্তব সত্য, তেইশশ বছর আগে যে সত্য অনুধাবন করেছিলেন চাণক্য, সেটা এই দুহাজার পনেরতে বসে আমরা ভুলে যাই। আপনার বাবা মা যদি পড়াশোনার বদলে বিয়েশাদি করতে চাপ দেন, নিজের মতের বিপরীতে গিয়ে সেই চাপে দয়া করে নত হবেন না। পরিণাম কিন্তু আপনি ভূগবেন, মা বাবা নয়!
আট: নতুন কিছু শিখতে যেন একটা দিনও বাদ না থাকে। হোক সেটা এক পৃষ্ঠা, একটা লাইন, এমনকী একটা অক্ষর।
আজকের শেখা একটা অক্ষর বহুবছর পর আপনার জীবনকে পালটে দিতে পারে মোক্ষম সময় এলেই।
নয়: আগুণ ছাড়াই ছয়টি অবস্থায় আপনি জ্বলে পুড়ে মরবেন
স্ত্রীর থেকে দূরে থাকলে, নিজের লোকের দ্বারা অপমানিত হলে, যুদ্ধে শত্রুর পক্ষ নিতে বাধ্য হলে, দুষ্ট শাসকের সেবা করলে, দরিদ্র হলে অথবা বিশৃঙ্খল কোন প্রতিষ্ঠানের সদস্য হলে।
আমার নিজস্ব অভিমত, উপরের ছয়টা ক্ষেত্রে যত জ্বলন জ্বলতে হয়, এক খারাপ স্ত্রী কপালে পড়লে এই ছয়টা সবগুলো একত্রে করলে যা হয় তার চাইতে বেশি জ্বালা জ্বলা লাগে।
একটাই জীবন, এই জ্বলুনি সহ্য করার প্রশ্নই আসেনা। If you feel like burning, kick off the fire-come what may
দশ: যে গাছে ফল হয়না সেটাকে পাখিরা পর্যন্ত ত্যাগ করে। আপনি যদি ফলপ্রসূ কিছু করার যোগ্যতা অর্জন না করেন, সবাই আপনাকে পরিত্যাগ করবে।
এগারো: সাপ আর বিশ্বাসঘাতকের মধ্যে সাপ বেশি নিরাপদ। সাপ ছোবল মারে শুধুমাত্র আক্রান্ত হলে কিন্তু বিশ্বাসঘাতক বদমায়েশ ছোবল মারে বিনা কারনেই।
আমার সাজেশন- বিশ্বাসঘাতকের সাথে ধোঁকাবাজি করতে দ্বিধা করবেন না। যেমন কুকুর, তেমন মুগুর।
বার: সীতা অপহৃত হয়েছিল তার অতিরিক্ত সৌন্দর্যের কারণে, রাবণের পতন হয়েছিল তার ইগোর কারণে। অতিরিক্ত কোনকিছুই ভালো নয়।
তের: পাঁচ বছর বয়েস পর্যন্ত সন্তানকে আদরের সাথে জড়িয়ে ধরুন, পরের দশ বছর তাকে কঠোর শৃঙ্খলার ভেতরে রাখুন। বয়েস ষোল হওয়ামাত্র তাকে নিজের সমান, একজন বন্ধু হিসেবে আচরণ করুন।
প্যারেন্টিং এর এর চাইতে সহজ সরল কিন্তু অসামান্য পরামর্শ তেইশ শ বছর আগের!!!! ভাবা যায়!!!
চোদ্দ: যতক্ষণ পর্যন্ত সুস্থ্য শরীর আছে এবং মৃত্যু অতি নিকটবর্তী বলে মনে হচ্ছেনা- নিজের আত্মাকে পরিশীলিত করতে থাকুন।
প্রিয় পাঠক, এটা আসলে নিয়মিত জিমে যাওয়ার সেকালের আহবান। শরীর সুস্থ না থাকলে মনের উন্নয়ন ভয়াবহ কঠিন, এটা মাথায় রাখুন!
পনের: স্বর্ণের শুদ্ধতা পরীক্ষা করা হয় চারভাবেঃ ঘষে, কেটে, উত্তপ্ত করে এবং হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে। একজন মানুষের মূল্যও চারভাবে নির্ধারণ করা যায়ঃ তার স্বার্থত্যাগ, আচরণ, গুণ এবং কাজকর্মের ধরণ দেখে।
জাপানিজ বারবিকিউ খেতে আসা আমার এক পরিচিত লোক হালাল মাংস না পেয়ে অভুক্ত থাকে, এই ভাইজানই সন্ধ্যার সময় তুর্কিশ দোকানে বসে রেড ওয়াইন আর দোনার কাবাব চিবোয়। সততা সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া এক সরকারী কর্মকর্তা কথা শেষ হবার পর আমাদের আপ্যায়নের ভার দেয় তার পরিচিত এক ব্যবসায়ীকে, যার সাথে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কথা না।
মোদ্দাকথা হল, কাজ দেখুন, কথা নয়।
ষোল: জন্মান্ধ ব্যক্তি যেমন দেখতে পায়না, কামান্ধ ব্যক্তিরও ভুল-শুদ্ধ জ্ঞান লোপ পায়।
মাত্রাজ্ঞান ছাড়াই শারীরিক আনন্দের দিকে যে লোক নজর দেয়, তার কাছ থেকে সাবধানে থাকুন। সুখাদ্য, সুস্থ যৌনতা ইত্যাদি শারীরিক আনন্দ অতীব জরুরী ওতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে লোকের কাছে ওগুলোই সব- এরকম লোকের কাছ থেকে দূরে থাকুন। “স্থান-কাল-পাত্র” বলে যে ব্যাপারটা আছে এটা যার মাথায় কাজ করেনা, ও ব্যাটা সুযোগ পেলে আপনার দিকেও হাত বাড়াবে।
সতের: লোভী লোককে উপহার দিয়ে, জেদী লোককে বিনয় বা প্রশংসা দিয়ে এবং বোকাকে আনন্দ দিয়ে বশ করতে পারবেন, কিন্তু একজন জ্ঞানী লোককে বশ করতে পারবেন শুধুমাত্র সত্য দিয়ে।
প্রিয় পাঠক, এখন আপনি যদি বোকাকে সত্য, লোভীকে বিনয় বা জ্ঞানী লোককে উপহার দিয়ে বশ করতে চান, হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেয়া মোটামুটি নিশ্চিত। যে দেবতা যে পূজায় তুষ্ট তাকে সেটা দিতে হবে, হোমোসেক্সুয়াল দেবতার কাছে ঐশ্বরিয়াকে পাঠিয়ে কি লাভ?!
ইয়ে, আমাকে বশ করতে চান? বই দিন!যে গর্দভগুলো টাকাপয়সা, নারী ইত্যাদি দিয়ে বশ করতে চাইতো এই অধমকে- আহা, তারা যদি জানতো আসল জিনিস কি!!! (যেহেতু প্রকাশ্যে বলে দিলাম, এখন এইটা আর কাজ করবেনা)
মহামতি চাণক্য আজ থেকে ২৩০০ বছর আগে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম জাতিসত্তার ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন, শিষ্য চন্দ্রগুপ্তকে দিয়ে সে যুগের সবচাইতে বড় সাম্রায্যের পত্তন করেছিলেন, ভারত অভিমুখে আলেকজান্ডারের আগ্রাসন ঠেকিয়েছিলেন, তারপর নিজ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন মানবজাতির সর্বপ্রথম অর্থনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার ম্যানুয়াল- “অর্থশাস্ত্র”।
কৌটিল্য ও বিষ্ণুগুপ্ত- উভয় নামে পরিচিত এই অসীম মেধাবী মানুষটির অন্যতম সেরা রচনা “নীতিশাস্ত্র”। এই নীতিশাস্ত্রের আবেদন এখনও অমলিন এবং প্রায়োগিক। যদিও কালের পরিক্রমায় তাঁর বেশ কিছু সূত্র এখন আর প্রযোজ্য নয়, তবুও স্ট্র্যাটেজির একজন অনুরাগী হিসেবে “অর্থশাস্ত্র” এবং “নীতিশাস্ত্র”- এ দুটোই অবশ্যপাঠ্য। যেহেতু ফেসবুকের এই যুগে কেউ মূল বইটি পড়তে চান না, তাই পাঠককূলের আগ্রহ জাগাতে নীতিশাস্ত্রের প্রায় চারশ শ্লোক থেকে বাছাই করা একশটি শ্লোক আপনাদের জন্যে তুলে ধরছি। প্রথম পর্বে পনের-বিশটি শ্লোক থাকবে।
মূল বইটি ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে, নিউমার্কেটে বা পাঠক সমাবেশে পাওয়া যাবে, আর পেঙ্গুইন ক্লাসিক অর্থশাস্ত্রের ইংরেজি বইটিও প্রকাশ করেছে। “কৌটিল্যম অর্থশাস্ত্রম” বইটি বাংলাতে এসব জায়গাতে পাওয়া যায়।
আমার এ অনুবাদ “The Aphorisms of Chanakya” বইটি থেকে করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যাগুলো আমার নিজস্ব। এ লেখা পড়ে কেউ যদি চাণক্যের রচনাবলী নিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী হন এবং সেগুলোকে নিজ জীবনে কাজে লাগান, এতেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।