হার্ভার্ডের দিনলিপি ০০৩

আজ জুয়িশ নববর্ষ- পুলিশিং এর উপর যে কোর্সটা নিয়েছি এর প্রফেসর যিনি, তিনি ইহুদি হওয়ায় ক্লাসটা হয়নি। এই ফাঁকে আরেকটা কাজ করেছি- একটা পাঁচ দিনের নন-ক্রেডিট রিডিং কোর্সে ভর্তি হয়েছি।

সারা জীবনে আমি বলার মত কোনও কাজ করতে পারিনাই, তবে একটা কাজ করেছি যেটা থেকে কিছুটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করি। ক্ষুদ্র সামর্থে যেটুকু কুলিয়েছে বই কিনেছি, পড়েছি এবং বুঝতে চেষ্টা করেছি।

হার্ভার্ডে জীবনের প্রথম ক্লাস করতে গিয়েছিলাম ওদের বিজনেস স্কুলে- প্রফেসর জুলির “ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি” শীর্ষক কোর্সে। বিশ্বাস করুন, এক সেকেন্ডের জন্যেও মনে হয়নি আমি এখানে মিস ফিট- ওরা কথায় কথায় যেসব বইয়ের রেফারেন্স দেয় সেগুলোর এক চতুর্থাংশ পড়া ছিল, বাকি তিনভাগের অন্ততঃ দুইভাগ নাম শুনেছি।ক্লাসে কন্ট্রিবিউট করতে সমস্যা হয়নি, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনেও এক বিন্দু অসুবিধা হয়নি।

একেকটা বইয়ের নাম শুনে যখন চিনতে পারছিলাম, বিশ্বাস করুন, আনন্দে চোখে জল আসছিলো। এই এক বই পড়া নিয়ে কি অত্যাচারটাই না সহ্য করেছি তেত্রিশ বছরের জীবনে! “ও বই পড়ে, বাস্তবের কিছু বোঝেনা”, “এইসব অতি জ্ঞানী ব্যক্তিকে দিয়ে কাজ চালানো যায়না ওর জায়গা হইলো লাইব্রেরিতে”, “বই পড়ার মত বিরক্তিকর একটা কাজ যে করতে পারে সে নিজেও ত বিরক্তিকরই হবে”- পুলিশ বিভাগের সহকর্মী, সাবেক প্রেমিকাদের এক দুজন থেকে শুরু করে নিকটাত্মীয়রাও খোঁচা দিতে ছাড়েনি সুযোগ পাওয়ামাত্র। আমেরিকা আসার সপ্তাহ খানেক আগে সব বই বিক্রি করে দেব বলে ঠিক করেছিলাম- টিকেটের টাকা কম পড়েছিল দেখে। একজন গোপন সুহৃদের বদান্যতায় সেই টাকা যোগাড় হয়েছে, সন্তানসম আমার বইগুলো শেষমেষ বিক্রি করতে হয়নি।

গোটা দুনিয়ার কাছে উপহাসের পাত্র হয়েছি বই পড়ি বলে- অথচ এই একটা মাত্র অভ্যাস আমার মত অতি সামান্য মানুষের জন্যে হার্ভার্ডের দরজা খুলে দিয়েছে, তাদের ক্লাসে বিশ্বের সেরা সব মেধাবীদের ভেতরে বুক ফুলিয়ে কথা বলার মত ধীশক্তি দিয়েছে। এমআইটি, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন, হার্ভার্ড থেকে আসা ছেলেমেয়েদের ভিড়ে বাংলাদেশের অখ্যাত মাসরুফ হোসেনকে কথা বলার শক্তি যুগিয়েছে।

প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, বই পড়ুন!

সকাল আটটায় রিডিং ক্লাস, প্রফেসর অরোরা ক্লাস নেবেন, ক্লাসরুম হার্ভার্ড ন্যাচারাল সায়েন্স সেন্টারের লেকচার হলে। ঘুম ঘুম চোখে গেলাম, একগাদা লেকচার শিট ধরিয়ে দিলো টিচিং এসিস্টেন্ট। প্রথমে আমাদেরকে দেখানো হল সবাই যেভাবে পড়ে সেই পদ্ধতি- প্রতিটা শব্দ ধরে ধরে বাম থেকে ডানে লাইন বাই লাইন পড়া। এই পদ্ধতি গল্প উপন্যাস পরার জন্য ঠিক আছে- যদি হাতে সময় থাকে প্রচুর তখন। কিন্তু হার্ভার্ডে যে বিশাল পরিমাণ রিডিং ম্যাটেরিয়াল দেয়া হয় তাতে এই পদ্ধতি মাঠে মারা যেতে বাধ্য। তাহলে উপায় কি? উপায় হচ্ছে স্ট্রাটেজিক রিডিং। এই স্ট্রাটেজি হবে রিডিং ম্যাটেরিয়ালের সাথে নিজেকে পরিচিত করে নেয়া, যথাসম্ভব অতীতের জ্ঞানের সাথে মিলিয়ে নতুন ম্যাটেরিয়াল বুঝে নেয়া, স্ট্রাকচার ধরে ধরে আগানো। পড়া মানে শুধু পড়া বা তথ্য সংগ্রহ না, পড়া মানে হচ্ছে চিন্তা করা। আগাগোড়া না পড়ে কিছু কী-ওয়ার্ড ধরে এগুলে অল্প সময়ে কিভাবে পুরো ম্যাটেরিয়াল বুঝে ফেলা যায় এটার কিছু টেকনিক হাতে কলমে শিখলাম ক্লাসে।

এই রিডিং ম্যাটেরিয়ালে একটা অসাধারণ অনুপ্রেরণামূলক প্রবন্ধ ছিল- এ্যাবিগেইল লিপসনের লেখা “দি জয় অফ এন্ডেভর”। প্রবন্ধটা এমন সব মানুষদের নিয়ে লেখা যারা কোনরকম আর্থিক বা জাগতিক পুরষ্কারের আশা ছাড়াই নিজেদের সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয় নিজের প্যাশনের পেছনে। কেন এই মানুষগুলো এরকম করে, এটা বোঝাতে লেখক উদাহরণ দিয়েছিলেন বারবারা ম্যাকক্লিনটক নামের একজন বায়োলজিস্টের। নারী বলে এই ভদ্রমহিলাকে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসরশিপ দেয়নি, তাঁর গবেষণা সময়ের চেয়ে বহু এগিয়ে থাকায় তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে নানা গঞ্জনা। এতকিছুতেও তিনি থেমে থাকেননি, নীরবে নিভৃতে গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন। একাশি বছর বয়েসে যখন তাঁকে নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির সংবাদ দেয়া হয় তখন তাঁর অনুভূতি ছিল এরকম- “This is so unfair! Why should I get such a big honor for having so much fun all my life!”

এ্যাবিগেইলের মতে, জীবন বিলিয়ে দেয়া এই মানুষগুলো বাইরের পুরষ্কারকে খুব একটা পাত্তা দেন না। পথ চলাতেই তাঁদের আনন্দ, গন্তব্য নিয়ে খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। তাঁরা জানেন যে ঠিক পথে এগুলে ওসব পুরষ্কার টুরষ্কার এমনিতেই আসবে।

রিডিং ক্লাস শেষে বিকেলে দেখা করলাম ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ক্লাসের সহপাঠিনী মারিড- এর সাথে। মারিড- এর কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নাম শুনে কি মনে হচ্ছে? অল্পবয়েসী সুন্দরী কোনও তরুণী?

মারিড আমেরিকার একজন মাল্টি মিলিওনেয়ার, সাতান্ন বছর বয়েস, তিন সন্তানের জননী। বড় ছেলে আছে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে, মেজ ছেলে এ্যাপেলের প্রোডাক্ট ডিজাইনার- ছোট মেয়ে গোল্ডম্যান স্যাক্সের কনসাল্ট্যান্ট। সাঁইত্রিশ বছর বয়েসে ওর স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যায়- তখন এই তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে এক রুমের একটা এপার্টম্যানতে সে ওঠে। সেখান থেকে কঠোর পরিশ্রম করে আজ ও এই জায়গায় এসেছে- হার্ভার্ডে এসেছে আজীবন লালিত স্বপ্ন স্পর্শ করতে। সাতান্ন বছর বয়েসে এই মেয়ের আচার আচরণ আমাদের দেশের কিশোরীদেরকে লজ্জা দেবে- এতটাই চটপটে সে।

শিহরিত হয়েছি ওর সাথে প্রায় এক ঘণ্টার কত্থোপকথনে। ওর বড় ছেলের স্বপ্ন ছিল বেসবল খেলোয়াড় হবার। হাই স্কুলে খেলার মাঠে হঠাৎ করে ওর মাথায় ব্যাটের বাড়ি লাগায় আর খেলতে পারেনি। খেলার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবার পর ছেলেটা যখন কাঁদছিল, মারিড তখন তাকে বলেছিল- শোনো বাবা, এটাই জীবন। চুপচাপ মনের আনন্দে নিজের কাজ করে যাচ্ছ, হঠাৎ দেখবে আচমকা ঝড়ে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। এই লণ্ডভণ্ড অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে প্যারাটাই জীবন।

যাবার সময় আমাকে বলল, ভালো থেকো মাই সন, আগামীকাল ক্লাসে দেখা হবে!

হার্ভার্ডের সৌন্দর্য এই জায়গাতেই। ক্লাসরুমে যতটা শেখা হয়- ক্লাসের বাইরে অসাধারণ সব মানুষদের সাথে পরিচয় আর মেলামেশায় তার চাইতে দশ গুণ বেশি শেখা যায়। দিস মেইকস অল দা ডিফারেন্স।

সন্ধ্যায় গিয়েছি হার্ভার্ড কোঅপারেটিভ শপে। এক্সেল সাইজের হুডি খুঁজছি, পাচ্ছিনা কিছুতেই। স্বর্ণকেশী এক তরুণীকে দেখে সেলসগার্ল ভেবে সহায়তা চাইলাম। মেয়েটা তিন চারটা হুডি এনে আমাকে দেখাল, প্রতিটা পরার পর বয়ফ্রেন্ডকে ডেকে মাপ ঠিক আছে কিনা চেক করালো। কথায় কথায় জানলাম ছেলেটার নাম এ্যান্ডি আর মেয়েটার নাম রুথ। এ্যান্ডি হার্ভার্ড এজুকেশন স্কুলের সবচেয়ে নাম করা ছাত্রদের একজন, রুথ ওর গার্লফ্রেন্ড এবং সহপাঠী।

যে মেয়েকে সেলস গার্ল ভেবে জামাকাপড় দেখতে সাহায্য চাইছিলাম এই রুথ -এর বাবা হচ্ছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট, মানে আমাদের ঢাবির ভিসির মত।

দিস ইজ হার্ভার্ড ফর ইউ গাইজ!

আজ আপাততঃ এটুকুই!

#হার্ভার্ড

Comments

comments