শৈশবস্মৃতি: বই (দ্বিতীয় পর্ব)

সেনাজীবনের সবচাইতে নিখুঁত বর্ণনা পড়েছিলাম মেজর আনোয়ার হোসেনের বই “হেলকমান্ডো” তে, সেবা প্রকাশনীর এ বইটি পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির দুর্ধর্ষ ট্রেনিং এর গল্পগুলো জেনে। মজার ব্যাপার, শেষের দিকে এ বইটার কথা মনে করলে হাসি পেত, এত এত ট্রেনিং করেও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাক আর্মি কেমন কাঁচকি মাইর খেয়েছিল সেটা ভেবে।

সত্যজিত রায়ের ফেলুদার ফ্যান ছিলাম না, আমার প্রিয় ছিল তাড়িনীখুড়ো আর প্রফেসর শঙ্কু। জ্ঞানকোষ থেকে বাবা দুটো বই কিনে দিয়েছিলেন, সেরা সত্যজিৎ এবং আরো সত্যজিৎ। কি অসাধারণ মেধাবী ছিলেন এই লেখক, তাঁর গল্পগুলোর পরতে পরতে তা বোঝা যায়। শঙ্কুর সবচেয়ে প্রিয় গল্প ছিল নওরোজ কিতাবিস্তানে ছাপানো একটি বইয়ে, সম্ভবত “আবারো প্রফেসর শঙ্কু”। ফুটবলের সাইজের একটি গ্রহ কিভাবে প্রফেসর শঙ্কুর কাছে আসে, যার বাসিন্দারা মূর্তিমান ভাইরাস- গল্পটি পড়ে শিউরে উঠেছিলাম। শঙ্কুর গল্পেই প্রথম বিবর্তনের নাম শুনি, কিভাবে একটি অদ্ভুত প্রানী ক্রমবিবর্তনের হাজার বছরের নিয়ম ভেঙে নিমেষেই দেহ পরিবর্তন করে সেই নিয়ে গল্পটি। “সেরা সন্দেশ” নামে আনন্দ পাবলিশার্সের একটা বই বাবা কিনে দিয়েছিলেন, সন্দেশ পত্রিকার সব বাছাই করা লেখা নিয়ে। গোগ্রাসে গিলেছিলাম!

বাসায় কিশোর পত্রিকা এবং কিশোর তারকালোক নামে দুটো পত্রিকা রাখতাম। কিশোর তারকালোক প্রতি ঈদে “ভূত সংখ্যা”, “ওয়েস্টার্ন সংখ্যা” , “সায়েন্স ফিকশন সংখ্যা” এরকম থীম বেইজড ডাইজেস্ট ছাপত। কারো কাছে এদের কোন একটা থাকলে আমাকে জানান, সোনার দামে কিনে নেব! (জানি, বিক্রি করবেন না, তাও বললাম!)

সুনীলের কাকাবাবু সিরিজের পড়া প্রথম বই “নীলমূর্তি রহস্য”। এক পা খোঁড়া হয়েও স্রেফ মনের জোরে পাহাড় ডিঙানো কাকাবাবু রাজা রায়চৌধুরী, চটপটে ভাগ্নে সন্তু, চাপাবাজ বন্ধু জোজো এবং পোষা কুকুর রকুকু, মিশর থেকে নেপালের পাহাড়চূড়ায় সঙ্গী হতাম ওদের অভিযানে। সুনীল শিশুদের মানসিক শক্তিকে জাগিয়ে ওঠার কথা শেখাতেন এভাবে, যার ফলে উপকৃতদের একজন আমি।

ভূত, বিজ্ঞান এবং গ্রামীন পরিবেশের অপূর্ব রসালো রকম
সংমিশ্রণ ঘটাতেন শীর্ষেন্দু, পড়ে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতাম কখনো, কখনো গভীরভাবে ভাবতে বসে যেতাম। “মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি” ,
“গোঁসাইবাগানের ভূত” কিংবা “পটাশগড়ের জঙ্গলে” – এত মজার ছিল এ বইগুলো! আজকালকার লেখকদের মত যাহা ইচ্ছা তাহা নয়, শীর্ষেন্দু বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোর প্রতি যথাসম্ভব সৎ থাকতেন। “বক্সার রতন” -এ প্রথম জানতে পারি শক্তির নিত্যতা সূত্রের কথা। আনন্দমেলার পূজোসংখ্যার দাম ছিল একশ টাকা, হাতে পাওয়ামাত্র শুরুতেই খুলতাম শীর্ষেন্দুর উপন্যাসটি। “নবীগঞ্জের দৈত্য” , “পাতালঘর”, “হেতমগড়ের গুপ্তধন” , “গৌরের কবচ” , “হীরের আংটি”- আহা, কি সব বই! মনে পড়লে এখনও জিভে জল আসে!

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের দুটো বই ছিল, “যকের ধন” এবং “আবার যকের ধন”। আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে বাঙালি দুই বন্ধুর গুপ্তধন উদ্ধারের কাহিনী নিয়ে। নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম বইদুটি। আজকে আইপ্যাডে ডুবে থাকা প্রজন্ম যদি জানত কি নেশা এই এ্যাডভেঞ্চার বইয়ে, আইপ্যাডের ব্যবসা লাটে উঠত!

দীনেশ স্যারের কাছে প্রথম শুনি বিভূতিভূষণের “চাঁদের পাহাড়” বইটির কথা। আফ্রিকাতে শঙ্কর নামের এক বাঙালি তরুন কিভাবে টিকে থাকে সাপখোপ আর সিংহের মাঝে, তাই নিয়ে গল্প। তাঁর আরো দুটি বই “আম আঁটির ভেঁপু” আর “তালনবমী” , আর পাতাল অভিযানের উপন্যাস “হিরেমানিক জ্বলে”। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও কি শক্তিশালী ছিলেন বিভূতিবাবু, এখনও যে কেউ এ বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন।

দেব সাহিত্য কুটির থেকে বের হত আয়তাকার, শক্ত মলাটের চিকন কিছু বই, কাপড় আর কাগজের বাধাই। একটা বই ছিল “সিনদোবাদ আলাদীন আলীবাবা”- তিনটা রূপকথার সচিত্র বর্ণনা পড়তাম মোহাবিষ্ট হয়ে। বানান করে করে পড়তাম, আর মাঝে মাঝে মৌলি আপু পাশে বসিয়ে পড়ে দিতেন ষোলশহরের ফরেস্ট কলোনীতে। কাঠবাদাম গাছের সোঁদা গন্ধ, ছোট্ট ফরেস্ট কলোনীর দুই রূমের বাসার বারান্দার গ্রীল ধরে এক হাতে বই আরেক হাতে দেয়াল, গ্রীলের ফাঁক দিয়ে পাহাড় পেরিয়ে সামনের দূরবর্তী সমুদ্র- ইশ, কি ভাবুকই ছিল সেদিনের ছোট্ট ছেলেটি!

আমার ছেলেবেলার প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ছিল কিরীটী রায়, প্রিয় ভিলেন কালোভ্রমর। নিহাররঞ্জন গুপ্ত লেখাগুলোকে অতিমাত্রায় মেলোড্রামাটিক করে ফেলতেন, সেই কিশোর বয়েসে পড়তে দারুণ মজা পেলেও এখন তার আবেদন সামান্যই। সে তুলনায় হাজারগুণ আকর্ষণীয় ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, গত দুশো বছরের সব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে যিনি কোন না কোনভাবে জড়িত।ভোজনরসিক ঘনাদাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে কিভাবে বনমালী লস্কর লেনের বাসিন্দারা গল্প বের করিয়ে নিচ্ছে, সেও ছিল গল্পের ভেতরে আরেক রসাল গল্প!

পটলডাঙার টেনিদাকে আজ আর কেউ চেনেনা, কিন্তু আমাদের সময়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই অমর চরিত্রটি দাপিয়ে বেড়াতো মনের অলিগলিতে। কাঠ বাঙাল হাবুল সেনের ঢাকাইয়া ভাষা, দুরন্ত সাহসী ক্যাবলার বুদ্ধিমত্তা, পিলেজ্বরে ভোগা প্যালারাম আর তাদের লীডার টেনিদা, রকের আড্ডায় এই চারজন জমিয়ে দিত মজাদার সব কাণ্ডকারখানা দিয়ে। টেনিদার গল্পেই প্রথম সম্রাট তেমুজিনকে (চেংগিস খান) চিনতে পারি। রহস্যপত্রিকাতে “ঝাউবাংলো রহস্য” উপন্যাসটি ছাপা হত ধারাবাহিক বিরতিতে, সেখানেই টেনিদার সাথে প্রথম পরিচয়। আজও কানে বাজে সেই উল্লাস ডাক: ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস! ইয়াক ইয়াক!

একজন প্রফেশনাল পুলিশ অফিসার হিসেবে কেউ যদি মাত্র একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আমাকে বাস্তবায়ন করতে বলে কোনরকম বাজেটের বাধা ছাড়া, যার মাধ্যমে সমাজের অপরাধ বৈপ্লবিকভাবে হ্রাস পাবে- আমি দেশের চৌষট্টি জেলায় চৌষট্টিটা “ছোটদের পাঠাগার” স্থাপন করতাম, চেষ্টা করতাম যত বেশি সংখ্যক শিশুকিশোর ভালো ভালো বইয়ের সাথে পরিচিত হয় সেটা নিশ্চিত করতে। অন্ধকার গুহায় মশালের যে কাজ, কিশোর মনে বই ঠিক একই কাজ করে। একজন বইপড়ুয়া মানুষ কখনো নিষ্ঠুর, বেপরোয়া হতে পারেন না, তাঁর মননশীলতা তাঁকে বাধা দেয়।

আজ থেকে প্রায় আটশ বছর আগে সিসিলিয়ান দার্শনিক থমাস এ্যাকুইনাস একটা মজার কথা বলেছেন- “এক বইয়ের পাঠক থেকে সাবধান!” মানে, যে হতভাগা জীবনে মাত্র একটা বা দুটো বই পড়ে সেই সীমিত জ্ঞান নিয়ে দুনিয়াটাকে দেখে, সেই হতভাগা সমাজের ভয়াবহ ক্ষতি করে বসতে পারে। কোমল কিশোর মনে বই যে স্বপ্নের বীজ বপ করে, তা মহীরূহ হয়ে সমাজটাকে গড়ে তুলতে পারে নন্দন কাননের অপরূপ রূপে। উল্টোটাও সত্য, ভুলভাল পুস্তকপাঠ সাধারণ মানুষকে দানবে রূপান্তিরিত করার ক্ষমতা রাখে। বইপড়ার যে সৌন্দর্য, সেই সৌন্দর্যের সন্ধান পাওয়া শিশু কিশোর জীবনে হোঁচট খেলেও উঠে দাঁড়াতে যে পারবেই, এ কথা নিশ্চিত বলা যায়।

আমার এ পোস্টটি যে বাবা মায়েরা পড়ছেন, সন্তানকে বিশ হাজার টাকার ট্যাব কিনে না দিয়ে দুহাজার টাকার বই কিনে দিন, ওর ভবিষ্যত অনেক বেশি শক্তপোক্ত হবে।

“এরা যত বেশি পড়ে,
তত বেশি জানে,
তত কম মানে”

আপনার সন্তান হীরক রাজার হাতে বন্দী থাকুক তা যদি না চান, তাকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করুন।

সব কিছু কেড়ে নেয়া যায়, জ্ঞান বাদে। বই হচ্ছে সেই জ্ঞানের বাহন।

এই স্বর্গীয় বাহনে তাকে চড়তে দিন, স্বর্গলাভ তার হবেই!

(চলবে )

Comments

comments