স্বচ্ছচিন্তা: বিয়ে বনাম স্বপ্ন

“হুম, চাকুরি করছিস, বিদেশে পড়াশোনা করছিস সব ঠিক আছে, কিন্তু এইটা কোন লাইফ না, তোর সেটেল হওয়া দরকার, ইউ নিড টু গেট ম্যারেড”

“গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিস, বিদেশে যেতে হলে বিয়ে করে জামাই সহ যাবি, একা তোকে বিদেশ পাঠানো যাবেনা|”

“আমার পরিচিত দুইজন মেয়ে বাইরে পড়াশোনা করেছে, দেশে এসে এখন তাদের জন্য কোয়ালিটি পাত্র পায়না- এখনো বিয়ে হচ্ছেনা| আমি চাইনা আমার মেয়েরও এমন হোক”

প্রিয় পাঠক, কথাগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে?

আমাদের বাবা মা বিশ্বের সবচাইতে বড় আপন জন আমাদের জন্য, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরাও এই মাইন্ড সেটের বাইরে বের হতে পারেন না|
আর এই মাইন্ডসেটে পেছনে দায়ী মহাশক্তিধর “সমাজ”|

আমাদের সামাজিক জীবনে বিয়ে একটি অপরিহার্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়| আমরা ইউরোপ আমেরিকা নই, আমাদের সমাজ গঠনে বিয়ে এখনও একটি অতীব জরুরী ভূমিকা পালন করে| এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই| বিয়ের বদনাম গাওয়াটাও এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়, দয়া করে কেউ ভুল বুঝবেন না|

আমার আপত্তি এই মাইন্ডসেটে| স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা না করে শুধুমাত্র সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা মেটানোর ভয়াবহ প্রেশার দিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে যখন বিয়ে করানো হয়, এর ফলাফল বেশিরভাগ সময়ে ভালো হয়না| ভুল মানুষের সাথে শুধু টাকাপয়সা, পড়ালেখা আর ফ্যামিলি স্ট্যাটাস দেখে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেয়ার ফলাফল হয় ডিভোর্স , নতুবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নরক যন্ত্রণা|
যে সমাজের চাপে বিয়েটা করানো হল, সেই সমাজ কিন্তু এতে চরম উল্লাসিত হয়, রসিয়ে রসিয়ে সহানুভূতি দেখানোর নামে গসিপ করে| আপনার চাপা যন্ত্রণা দেখে আপনার বাকি সাফল্যগুলোকে খাটো করতে এদের জিভ দিয়ে লালা ঝরে, জনে জনে বলে বেড়ায়- ” যাক, ব্যাটা/ বেটি এইবার কায়দা মত ধরা খেয়েছে| কি লাভ হল ক্যারিয়ার গড়ে, আসল জায়গায় তো ধরা! ”

আমার এক অতি মেধাবী বান্ধবীর গল্প বলি| এই মেয়ে বিশ্বের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছে, চমৎকার গবেষণা করছে| ওর স্বপ্ন বাংলাদেশে থাকবে, দেশে বসেই স্যার জগদীশচন্দ্রের মত বিশ্বমানের গবেষণা করবে, দেশটাকে এগিয়ে নেবে| এই বেচারীর সাথে পরিচয় করানো হল দেশের বাইরে থাকা আরেক মেধাবী ভদ্রলোকের, যিনি কখনোই দেশে আসবেন না| দুজনই অত্যন্ত ম্যাচিউরড, কথা বলেই বুঝলেন যে তাঁদের পথ ভিন্ন- তাই কোনরকম হার্ড ফিলিংস ছাড়াই আলাদা হয়ে গেলেন|

মজার ব্যাপার, এনাদের বাবামায়েরা ছেলেকে প্রেশার দিয়েছেন এটা বলে, “আরেহ, বিয়ের পর মেয়েকে বুজিয়ে বাইরে আনা যাবে” আর মেয়েকে বলেছেন,” ধুস, বিয়ে হলে ছেলে দেশে চলে আসবে”

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, WHY????

কেন একজন মানুষকে তার স্বপ্নকে বলির পাঁঠা বানাতে হবে?

আমি একজন পুলিশ অফিসার, সেই পুলিশে যোগদানের দিন থেকে আমার মনে একটা স্বপ্ন আছে| আল্লাহ যদি দেন, আমি বাংলাদেশের একেবারে কোনায় ছোট্ট কোন জেলার এসপি হব| সেই জেলার স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে বিকেলে ক্রিকেট খেলব, ওদেরকে ভাল মানুষ হওয়াটা যে ভাল চাকুরি করার চেয়ে জরুরী – এটা শেখাব| আমার জেলায় মানুষজন দরজা খুলে ঘুমাবে|

এখন, অতি মেধাবী, গুনবতী, রুপবতী এবং সেইরকম ফ্যামিলির কোন মেয়েকে যদি আমি বিয়ে করি যে ঢাকার বাইরে থাকার কথা শুনলে মূর্ছা যায়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? যে সমাজের চাপে এই “লোভনীয়” বিয়েটা আমি করলাম, সেই সমাজ কি আমার স্বপ্নহত্যার দায় নেবে?

নেবেনা|

একটা মানুষের স্বপ্নের চাইতে বড় কোন কিছুই না, এই স্বপ্ন হচ্ছে তার অস্তিত্ব|
আপনাকে পাবার বিনিময়ে কেউ যদি আপনার স্বপ্নটাকে বাদ দিতে চায়, তাকেই আপনি আপনার জীবন থেকে বাদ দিন|

To HELL with rest of the world.

ধন্যবাদ

প্রথম প্রকাশিতঃ ৭ই জুন, ২০১৫

Comments

comments