পুস্তক সমালোচনাঃ অন্ধকারের একশ বছর

এইমাত্র শেষ করলাম কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের “অন্ধকারের একশ বছর”।
সত্যি কথা বলতে কি, থমকে গিয়েছি বইটি পড়ে। এই লেখাটি খুব বড় নয়, মাত্র নব্বই পৃষ্ঠা।বইটা পড়বার পর আপনি শিউরে উঠবেন এর সত্যতা কল্পনা করে।
ছোট্ট একটা বইতে মৌলবাদের বীভৎস চিত্র যেভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন, আমার কাছে এটি হুমায়ূন আযাদ স্যারের “পাক সার জমিন সাদ বাদ” এর চাইতে অনেক বেশি নিখুঁত, সাবলীল এবং শক্তিশালী লেগেছে।

কল্পনা করুন এমন একটি দেশ যেখানে সব হারমোনিয়াম একসাথে জড়ো করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে যাতে কেউ গান গাইতে না পারে।

কল্পনা করুন এদেশে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ, ধ্বংস হয়েছে অব ভাস্কর্য।
কল্পনা করুন, বিবর্তনবাদ পড়ানোর অভিযোগে শিরচ্ছেদ করা হয়েছে শিক্ষকদের ।

কল্পনা করুন, বদরীয়া বাহিনী যাকে ইচ্ছা তাকেই তুলে আনছে গণিমতের মাল হিসেবে, ধর্ষণ করছে কন্যা জায়া জননীদের।

আমার ক্ষমতা থাকলে এই বইটি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলক করে দিতাম, কোমলমতি ছাত্ররা যেন মৌলবাদের বীভৎসতা বুঝতে পারে।

বইটি লিখতে প্রচন্ড পরিশ্রম করেছেন লেখক, পড়েছেন অসংখ্য ধর্মীয় পুস্তক।আলো বনাম অন্ধকারের যে লড়াই, গোটা বাংলা সাহিত্যে এই বইটার মত সূচারুভাবে আর কোন বইতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা জানা নেই আমার।

সবচেয়ে অসাধারণ অংশটুকু সরাসরি তুলে দিই, বিবর্তনবাদ পড়ানোর কারণে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত শিক্ষক রফিকুল হকের সাথে দণ্ডদাতা “আতিউর রহমান মিজানী” এর কত্থোপকত্থন:

/// সবাই তাকায় রফিকুল হকের দিকে।রফিকুল হক নীরবতা ভাঙেন। তিনি বলেন, “আমাদের কলেমা তৈয়ব ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ এর প্রথমেই কেন লা ইলাহা বলা হল? এর মানে কি? কোন উপাস্য নেই। তারপর বলা হল, ইল্লাল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া।এর ব্যাখ্যা কী? এর ব্যাখ্যা এই যে,অতীতের যত বিশ্বাস, যত সংস্কার সব প্রথমে অস্বীকার করা হল।তারপর শাদা পৃষ্ঠার মত শূন্য হৃদয়ে লেখা হল আল্লাহর নাম। জ্ঞানচর্চার মূল ব্যাপারটিও তাই।প্রথমে সব সংস্কার থেকে মুক্ত হতে হবে। সব বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।তারপর জানার চেষ্টা করতে হবে, সত্য কি। আমি সেই জ্ঞানের সন্ধানই করছি” ///

আজ থেকে বিশ বছর আগে অসংকোচে এরকম অসাধারণ শক্তিশালী উচ্চারণ যে লেখক করতে পেরেছিলেন , চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার এই অধ:পতন দেখে। বিশ্বাস হয়, এই একই লোক আজকাল ফেসবুকে একেবারে ল্যাদল্যাদে, ভ্যাটকানো সব শব্দবিষ্ঠাসুলভ নোট লেখে?

অন্ধকারের একশ বছর বাংলা সাহিত্যের একটি ক্লাসিক, ইটস আ কাল্ট নভেল। অনেকটা টারান্টিনোর পাল্প ফিকশনের মত।”মা” নয়, এই বইটির জন্যে লেখক আনিসুল হক আমার পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন নিলেন।

পাঁড় কমার্শিয়াল, সুশীলিয় ভন্ডামি ও কর্পোরেট ভাড়া খাটা আজকের সেলফিবাজ কুফামাস্টার পুটুন দা এক কালে সত্যি সত্যি কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ছিলেন, এটা জানার জন্যে হলেও এই বইটি পড়ুন।

Comments

comments