অগ্নিপুরুষ হাতে অগ্নিপুরুষের সাথে‬

(দীর্ঘ, স্মৃতিকাতর লেখা। হাতে মিনিট পাঁচেক সময় থাকলে চোখ বুলাতে পারেন)

-ইয়ং ম্যান, এত এত অন্য অপশন থাকতে আর্মিতে আসতে চাও কেন??
– স্যার, আই ওয়ান্ট টু বি লাইক মাসুদ রানা।

দুহাজার তিন সালের শেষের দিকে আইএসএসবি তে ঠিক এই উত্তরটা দিয়েছিলাম।আর্মিতে বেশিদিন সার্ভ করা হয়নি, কিন্তু উত্তরটা মনের খাতায় জ্বলজ্বল করছে এই এক যুগ পরেও।

মাসুদ রানা আমার ছেলেবেলার নায়ক, দুর্ধর্ষ এই বাঙালি যুবকের চোখেই আমি সর্বপ্রথম বিশ্বকে দেখি। দুর্দমনীয় পৌরুষের সংজ্ঞা কি হতে পারে, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ স্পাই মাসুদ রানার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারি।

জানিনা, আজকের প্রজন্ম মাসুদ রানার বই পড়ে শিহরিত হয় কিনা,কিন্তু বাজি লেগে বলতে পারি, এপার ওপার দুই বাঙলা মিলিয়ে আর কোনও বাঙালি চরিত্র ওর মত বর্ণিল এবং দুর্ধর্ষ নয়।

মাসুদ রানার সবচাইতে প্রিয় বই অগ্নিপুরুষ- ইতালিতে রানা একাই কিভাবে গোটা মাফিয়া চক্রকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেই কাহিনী নিয়ে লেখা। কিশোর বয়েসে পড়েছিলাম বইটা, লুবনার জন্যে ডুঁকরে কেঁদেছিলাম। তারপর রানা যখন একে একে চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে মাফিয়া ডন পর্যন্ত পৌঁছে গেল, প্রচন্ড গর্ব আর উত্তেজনায় শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম বইটার প্রতি ছত্রে ছত্রে।

কত অসংখ্যবার যে বইটা পড়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। কুইনেলের ম্যান অন ফায়ার এর অরিজিনাল বই, হিন্দি ইংরেজি মিলিয়ে তিনটা সিনেমা এবং হুমায়ূন আহমেদের অমানুষ- সব কিছু মিলেয়েও অগ্নিপুরুষকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। রিভেঞ্জ থ্রিলারের যদি লিস্ট করা হয়, কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টোর পরেই আমি অগ্নিপুরুষকে রাখব।

জানি,সাহিত্যবোদ্ধারা হইহই করে উঠবেন উপরের লাইনটা পড়ে, কিন্তু আমার কথা পরিবর্তন করতে আমি রাজি নই। কৈশোরে যে মুগ্ধতা নিয়ে আমি বইটা পড়েছিলাম, বিশ্বের সেরা সাহিত্য সমালোচকের তকমা লাগিয়েও সেই মুগ্ধতা বিসর্জন দিতে আমি অপারগ ।

পুলিশে যোগদানের পরেও এই মুগ্ধতা কাটেনি।চুয়াডাঙ্গায় প্রথম যেবার সন্ত্রাসীর আখড়ায় রেইডে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম ( ওটা ছিল আমার ব্যাপটিজম অফ ফায়ার, ক্যারিয়ারের প্রথম অভিযান), যাবার ঘন্টাদুয়েক আগে খুব নার্ভাস লাগছিল। মনোবলকে জাগিয়ে তুলতে পড়েছিলাম “অগ্নিপুরুষের” কয়েকটা ছত্র- নিজেকে কল্পনা করেছিলাম রানার ভূমিকায়, যে কিনা আরেকটু পরেই ডন বাকালার ডেরায় আক্রমণ করতে যাচ্ছে।

পুলিশে বিপজ্জনক কাজ যখন করতে হয়, সিনেমার মত নায়কের মন কিন্তু নির্ভয় থাকেনা। তার মনের ভেতরেও মৃত্যুভয় কাজ করে, কারণ সে জানে- সিনেমার মত এখানে নায়ককে গুলি করলে সে্টা ফসকে যাবেনা। এই ভয়টা কখনোই দূর করা যায়না, দূর করা উচিতও নয়। এবার দিল্লী থেকে টোকিও আসার পথে সহযাত্রী ভারতীয় কর্নেল বলবিন্দর সিং একটা কথা বলেছিলেন যেটার সাথে আমি সর্বাংশে একমতঃ অপারেশনের সময় বোকা বোকা সাহসই সবচেয়ে বেশি বিপদ ডেকে আনে। নিয়মিত ট্রেনিং যেটা করে, ভয়ভীতিটাকে এমন একটা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনে যাতে মাথাটা কাজ করে। কমান্ডো স্কুলে আমার ইন্সট্রাকটর মেজর মঞ্জুর স্যারের ভাষায়, Courage is keeping your fear under control just one minute longer, it does not mean the absence of fear.

এই এক মিনিট বেশি সময় সাহস ধরে রাখতে কতবার যে মাসুদ রানা আমাকে সহায়তা করেছে, বলে বোঝান যাবেনা। মাসুদ রানার কাছে আমার ঋণ কখন পরিশোধ করতে পারবনা। আমার খুব শখ, শার্লক হোমস মিউজিয়ামের মত বাংলাদেশে একটা মাসুদ রানা মিউজিয়াম গড়ে তোলা হক কোন এক সময়ে!

দুহাজার তের সালের দশ সেপ্টেম্বর। পাঠকজন্ম স্বার্থক করা যে কটা দিন আছে, এ দিনটি তারই একটি। বিশ্বপরিব্রাজক অনু তারেক ভাইয়ের সাথে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম বিসিআই হেডকোয়ার্টারে, উদ্দেশ্যঃ স্বয়ং মেজর জেনারেল (অবঃ) রাহাত খানের সাথে দেখা করব।

প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন, আমি সেবা প্রকাশনী এবং কাজী আনোয়ার হোসেনের কথা বলছি!

অনু ভাইয়ের কারণে স্বপ্নজগতের এই মানুষটার সাথে প্রায় তিন ঘন্টা আড্ডা দিয়েছিলাম, যেটা নিয়ে বিস্তারিত ব্লগ লেখার ইচ্ছে আছে ।

অবাক হয়ে জানতে পারলাম, বহু মুক্তিযোদ্ধাকেও অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে মাসুদ রানা। মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনে গিয়ে তারা ধারণ করেছে মাসুদ রানার স্পিরিট, পাকসেনার বাংকারে ছুঁড়ে দিয়েছে বিধ্বংসী গ্রেনেড। একটা কাল্পনিক চরিত্র এভাবেই সবার অজান্তে স্থান নিয়ে ফিরেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, যেটা বেশিরভাগ মানুষই জানেনা।

মাসুদ রানা কি পারেনা? এক কিশোর কাজীদাকে এই প্রশ্নটি করেছিল। কাজীদা বলেছিলেন, মাসুদ রানা পারেনা এমন কিছুই নেই।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, এমন কেন, কাজীদা?? তিনি বললেন, আমি চেয়েছি মাসুদ রানা হবে এমন একটি বাঙালি চরিত্র যে কিনা বাঙালি পাঠককে অনুপ্রেরণা যোগাবে অসম্ভবকে সম্ভব করার- হেলিকপ্টার থেকে সাবমেরিন চালনা, মেশিনগান ফায়ারিং থেকে হ্যাকিং, সব কিছুই থাকবে তার নখদর্পনে।বাঙ্গালি কি করতে পারে, মাসুদ রানা হবে তার একটা মডেল।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কাজীদার এই স্বপ্ন সর্বাংশে সত্য হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে একালের বাংলাদেশ পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর বহু অফিসার মনে মনে মাসুদ রানাকে হিরো হিসেবে দেখেছেন, নিজেকে গড়বার চেষ্টা করে তুলেছেন মাসুদ রানার আদলে।এই অধম তাদেরই একজন!

শুরুতে যা বলেছিলাম পুনরাবৃত্তি করিঃ মাসুদ রানা আমার স্বপ্নের নায়ক। মফস্বলে বেড়ে ওঠা এক কিশোরকে এই কাল্পনিক বাঙালি যুবকটি একটানে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে লন্ডন থেকে প্যারিস, সঙ্গী করেছে দুর্ধর্ষ সব মিশনের। আজও যখন বিশ্বের নতুন কোন প্রান্তে পা রাখি,মনে মনে ভাবি মাসুদ রানা এই পরিস্থিতিতে কি করত, এবং সেটা করতে চেষ্টা করি।

আরেকটা বিষয়ে মাসুদ রানাকে ধন্যবাদ দিতে চাই, যদিও জানি এটা নিয়ে দুষ্ট পাঠক কিঞ্চিৎ হাসাহাসি করবেন। ক্যাডেট কলেজের ছাত্র থাকায় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কৈশোরের যে সহজাত এবং স্বাভাবিক আকর্ষণ, এই আকর্ষণটাকে বিপথে যেতে দেয়নি মাসুদ রানা। নারীদের মাংসের টুকরো হিসেবে দেখে নয় বরং ভদ্রোচিত পৌরুষ দিয়ে চিত্তজয় করতে হয়- এ শিক্ষাটা আমার মনে গেঁথে দিয়েছে মাসুদ রানা। অন্যেরা কে কি বলবেন জানিনা, রানার নারীভাগ্যে ঈর্ষা করেনা এমন কেউ থাকলে তার পৌরুষ নিয়েই হয়ত সন্দেহ প্রকাশ করে ফেলব আমি!!!

ইতালির কারাবিনিয়ারি রিজিওনাল হেডকোয়ার্টারে সর্বপ্রথম আমাকে বেরেটা নাইন্টিটু পিস্তল দেয়া হয়। ইতালির মিলিটারি পুলিশ কারাবিনিয়ারির কথা আপনারা অন্ততঃ দুটো জায়গায় পাবেনঃ মারিও পুজোর গডফাদারে এবং মাসুদ রানার অগ্নিপুরুষে। রমনীমোহন কর্নেল গুগলিকে মনে আছে, যার একান্ত রোমান্টিক মুহূর্তগুলোতেই কেবল রানা সব বিপজ্জনক ঘটনাগুলো ঘটাতো? এই কর্নেল গুগলি ছিলেন কারাবিনিয়েরি অফিসার।

জীবনে প্রথম বেরেটা নাইন্টি টু হাতে নিয়ে আমি দশ রাউন্ডের দশটাই দুই ইঞ্চি গ্রুপিং করেছিলাম। আমি ন্যাচারাল শ্যুটার নই, পঁচিশ গজ দূরত্বে এই গ্রুপিং হয়ত আহামরি কিছু না।কিন্তু সার্জেন্ট বেনিতো এত খুশি হয়েছিলো, ওর সবুজ রঙের হোলস্টারটা আমাকে গিফট করেছিল।

দেশে এসে আর কখনো ওই মানের শ্যুটিং করতে পারিনি। এর কারণ একটাই, ভিচেনজা সিটিতে কারাবিনিয়েরি শ্যুটিং গ্রাউন্ডে সেদিন মাসরুফ হোসেন শ্যুটিং করেনি, তার হয়ে শ্যুট করেছিল মাসুদ রানা।

ছবিতে আমার সাথে দেখছেন কাজী আনোয়ার হোসেনকে, প্রিয় বই অগ্নিপুরুষ হাতে নিয়ে সত্যিকারের অগ্নিপুরুষের সাথে ছবি তুলছি।

আঁতেলের দল যতই নাক সিঁটকাক, বাংলাদেশের কয়েকটা প্রজন্মকে হাতে ধরে বই পড়া শিখিয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন আর তাঁর সৃষ্ট সেবা প্রকাশনী।

অসম্ভব প্রচারবিমুখ এই মানুষটি নীরবে, নিভৃতে তিরাশি বছর বয়েসেও সমানভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, সৃষ্টি করে যাচ্ছেন একের পর এক রোমাঞ্চকর বই।

এই পোড়া দেশে গরু ছাগল ভেড়া মহিষ শিয়াল কুকুর সব্বাই নামকরা সব পুরষ্কার পায়, আর কর্তাব্যক্তিদের কাছে কাজীদা হন উপেক্ষিত।

কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের চাটুকারদেরকে একের পর এক পুরষ্কার দিতে থাকুক, আমার স্বপ্নালু পাঠক হৃদয়ের সর্বোচ্চ পুরষ্কারটি আমি কাজীদাকে বহু আগেই দিয়ে রেখেছি।

এবং আমি জানি, আমি মোটেও একা নই!!!!

Comments

comments